শুধু তুমি থেকো পাশে
|

“শুধু তুমি থেকো পাশে”

তৃতীয় পর্ব

স্বপ্নের রঙ

ভালোবাসার প্রথম দিনগুলো সবসময়ই রঙিন হয়।
অয়নের কাছে গ্রামটা হঠাৎ করে একেবারে অন্যরকম হয়ে উঠল। পুকুরের জল যেন ঝকঝকে হয়ে উঠল, মাঠের সবুজ যেন আরও উজ্জ্বল লাগতে লাগল, আকাশের মেঘও যেন নতুন রূপে সাজল।

কারণ, পাশে মায়া আছে।

দুজনের দিনগুলো ভরে উঠল গল্পে, হাসিতে আর ছোট ছোট স্বপ্নে।
মায়া যখন স্কুল থেকে ফিরত, অয়ন অপেক্ষা করত পুকুরপাড়ে। হাতে থাকত কোনো নতুন বই। মায়া হেসে বলত,
“আজ আবার কী পড়াবে আমাকে?”

অয়ন বইয়ের পাতা উল্টে বলত,
“তুমি গান শোনাবে, আমি কবিতা পড়ব। আমরা দুজনেই আমাদের স্বপ্নগুলো ভাগাভাগি করব।”

এভাবেই ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল তাদের নিজস্ব জগৎ—যেখানে ছিল না কোনো ভয়, কোনো বাঁধা, কোনো প্রশ্ন।

একদিন অয়ন বলল,
“জানো মায়া, আমি ছোটবেলা থেকে গল্প লিখতে ভালোবাসি। কিন্তু কখনো কাউকে দেখাইনি। সবাই চায় আমি পড়াশোনা করে বড় অফিসার হই। কিন্তু আমি মনে মনে চেয়েছি—লেখক হতে।”

sudhu tumi theko pase 3 parba 1 pic

মায়া মুগ্ধ হয়ে তাকাল।
“তাহলে তো আমরা একে অপরের সঙ্গী হতে পারি! আমি গান গাইব, তুমি লিখবে। কেমন হয়?”

অয়ন হেসে মাথা নাড়ল,
“তাহলেই তো স্বপ্নের জগৎ তৈরি হবে।”

মায়ার চোখ ঝিলমিল করে উঠল।
“হ্যাঁ, আমরা দুজন দুজনের স্বপ্ন হয়ে উঠব।”

সন্ধ্যায় গ্রামের মাঠে দুজন বসেছিল। দূরে বাঁশির সুর ভেসে আসছিল। অয়ন ডায়েরিতে কিছু লিখছিল, মায়া পাশে বসে গুনগুন করছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত। হঠাৎ মায়া বলল,
“অয়ন, তুমি যদি লেখক হও, আর আমি গায়িকা—তাহলে একদিন আমরা একসঙ্গে একটা বই আর গান বের করব। বইতে থাকবে তোমার লেখা, গানে থাকবে আমার কণ্ঠ। মানুষ তখন আমাদের চিনবে।”

অয়ন মায়ার স্বপ্নমাখা চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে ভাবল—
“এটাই তো জীবনের আসল মানে—কারও সঙ্গে এমন করে স্বপ্ন বোনা।”

মায়া আর অয়ন—দুজনের আলাপ এখন কেবল আলাপের সীমায় আটকে নেই। ধীরে ধীরে তারা একে অপরের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছিল।

অয়ন শহরের ছেলে হলেও গ্রামের সরলতাকে নতুন করে চিনছিল মায়ার চোখ দিয়ে। প্রতিটি গাছপালা, প্রতিটি পাখির ডাক, প্রতিটি মেঘের চলা—সবকিছুই মায়ার উপস্থিতিতে ভিন্ন হয়ে উঠছিল। আর মায়ার মনে হচ্ছিল, জীবনে প্রথমবার কেউ তাকে সত্যিই বোঝার চেষ্টা করছে।

এক বিকেলের আড্ডা

সেদিন সন্ধ্যায় দুজনে বসেছিল বাঁশবনের ধারে। বাতাসে দোলে দোলে শিস বাজাচ্ছিল বাঁশপাতা। অয়ন বলল—
“মায়া, তুমি কি ভেবেছো, সত্যিই যদি গানকে জীবন বানাও, তবে কেমন হবে?”

মায়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিল—
“ভেবেছি। কিন্তু ভয়ও লাগে। আমার পরিবার হয়তো কখনো মেনে নেবে না। তারা চায় আমি শিক্ষকতা করি, সংসার করি। গানকে তারা নেহাত শখই ভাবে।”

অয়ন মায়ার চোখে তাকাল।
“কিন্তু তোমার গানের ভেতরে আমি স্বপ্নের আলো দেখি। তুমি যদি হাল ছাড়ো, তাহলে সেই আলো নিভে যাবে। আমি চাই তুমি তোমার গানকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরো।”

মায়া এক মুহূর্তে অয়নের হাত ধরে ফেলল।
“তুমি পাশে থেকো তবে… আমি পারব।”

অয়নের মনে ঢেউ খেলে গেল। এতদিনের সংযত মনটা যেন ভেঙে পড়তে চাইছিল। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল। শুধু বলল—
“আমি আছি। সবসময়।”

🌸 মায়ার ডায়েরি

সেদিন রাতে মায়া ডায়েরিতে লিখল—

“আজ অয়ন বলল আমি যেন গান না ছাড়ি। কেউ কখনো আমার স্বপ্ন নিয়ে এত গুরুত্ব দেয়নি। আমি জানি, অয়ন আমার জীবনে বিশেষ হয়ে উঠছে। ভয় হয়… যদি একদিন ও চলে যায়?”

গ্রামের মানুষ খুব দ্রুতই এই দুজনকে লক্ষ্য করতে শুরু করল।
কেউ বলত—
“ওই শহুরে ছেলেটা মেয়েটাকে ভোলাচ্ছে।”
কেউ বলত—
“দুজনের চোখে চোখ পড়লেই বোঝা যায় কী চলছে।”

এইসব কথা পৌঁছতে লাগল মায়ার ভাই রূপমের কানে। সে ধীরে ধীরে বিরক্ত হয়ে উঠছিল।

অন্যদিকে, অয়নও বুঝতে পারছিল, গ্রামের এই কটুকথা একদিন না একদিন তাদের সম্পর্কের ওপর ঝড় নামাবে। তবুও সে চায়নি মায়ার চোখের স্বপ্নের রঙ মলিন হোক।

একদিন অয়ন মায়াকে বলল—
“তুমি যদি গান শেখার জন্য শহরে যেতে চাও, আমি তোমাকে সাহায্য করব। অন্তত ট্রেনিংটা তো দরকার।”

মায়ার চোখ চকচক করে উঠল।
“সত্যিই পারব?”

“পারবেই তো। তোমার স্বপ্ন মানে আমার স্বপ্ন।”

মায়া হেসে ফেলল, আর সেই হাসির মধ্যে লুকিয়ে ছিল আস্থা, ভালোবাসা আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।

sudhu tumi theko pase 3 parba 3 pic

শরৎকাল চলে এসেছে। আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, কাশফুলের দোলায় গ্রাম যেন উৎসবের সাজে। এই সময়েই অয়ন আর মায়ার বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়ে উঠছিল।

🎶 প্রথম গান রেকর্ড

এক বিকেলে অয়ন তার ছোট্ট মোবাইল ফোন বের করল।
“মায়া, আজ তোমার গান রেকর্ড করব। কেমন?”

মায়া লজ্জা পেয়ে বলল—
“আরে, আমি তো কোনো শিল্পী নই।”

অয়ন হেসে উঠল—
“তুমি জানো না, তুমি কত বড় শিল্পী। একদিন তুমি যখন মঞ্চে গান করবে, আমি এই রেকর্ড শোনাবো সবাইকে—বলো, এটাই ছিল শুরু।”

মায়া ধীরে ধীরে গান ধরল—
“আমার স্বপ্ন তুমি, আমার গানের সুর…”

তার কণ্ঠে যেন মাঠের খোলা হাওয়া, কাশফুলের দোলা, নদীর ঢেউ মিশে গেল। অয়ন রেকর্ড বাটন চাপা অবস্থায় চোখ বন্ধ করে শুনছিল। মনে হচ্ছিল, এই কণ্ঠ শুধু গান নয়, তার নিজের হৃদস্পন্দন।

রেকর্ড শেষ হলে অয়ন চুপচাপ মায়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
“তুমি জানো, আমি আজীবন এই মুহূর্তটা মনে রাখব।”

মায়া চোখ নামিয়ে নিল। বুকের ভেতরে অদ্ভুত একটা কাঁপুনি।

🌪 ঝড়ের আগাম বার্তা

তাদের এই সখ্য খুব দ্রুতই গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। কারও চোখে সেটা নিষ্পাপ বন্ধুত্ব, আবার কারও চোখে কুকথার খোরাক।

রূপম একদিন মায়াকে জিজ্ঞেস করল—
“শোন, ওই শহুরে ছেলেটার সাথে এত ঘুরঘুর করছিস কেন?”

মায়া উত্তর দিল—
“আমরা শুধু বন্ধু।”

রূপম গম্ভীর চোখে তাকাল—
“বন্ধুত্ব যদি সীমার মধ্যে না থাকে, তখন সমাজ মেনে নেয় না। সাবধানে চলিস।”

মায়া কিছু বলল না, তবে বুকের ভেতর অদ্ভুত ভয় জমে গেল।

অন্যদিকে, অয়নও অনুভব করছিল চাপ। গ্রামের চায়ের দোকানে বসলে লোকজন খোঁচা দিয়ে বলত—
“বাহ, নতুন শহুরে জামাই এসেছে নাকি?”

সে শুধু হেসে উড়িয়ে দিত, কিন্তু মনে মনে ভাবত—
“আমি যদি মায়ার স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারি, তবে এই কটুকথার কোনো দাম নেই।”

🌈 স্বপ্নের রঙে ভবিষ্যৎ

অয়ন একদিন মায়াকে নিয়ে নদীর ধারে বসল। সোনালি রোদ তখন জলের ওপর ঝিলিক দিচ্ছে।

sudhu tumi theko pase 3 parba 2 pic

“মায়া, তুমি কি জানো, আমি সবসময় তোমার গানের ভেতর ভবিষ্যৎ দেখি। একদিন তুমি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে গান গাইবে, হাজার হাজার মানুষ হাততালি দেবে। আর আমি বসে থাকব সামনের সারিতে।”

মায়া অবাক হয়ে অয়নের দিকে তাকাল।
“তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস করো, আমি এতটা পারব?”

অয়ন দৃঢ় গলায় বলল—
“হ্যাঁ, বিশ্বাস করি। কারণ তোমার গানে আমি স্বপ্নের রঙ দেখি।”

মায়ার চোখ ভিজে উঠল। এই প্রথম কেউ তাকে এভাবে বিশ্বাস করল।

সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—
“যাই হোক, আমি গান ছাড়ব না। অয়ন পাশে থাকলেই সব সম্ভব।”

এভাবেই স্বপ্নের রঙ ধীরে ধীরে ঘন হতে শুরু করল। কিন্তু সেই রঙের আড়ালে জমে উঠছিল অজানা অন্ধকার, আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস…

“মায়ার হাসি কি চিরকাল টিকল, নাকি সমাজের বাঁধন টেনে নিল অয়নের স্বপ্নকে? জানতে হলে অপেক্ষা…”
👉 পর্ব ৪ : সমাজের বাঁধন

📖 আগের পর্বগুলো পড়ুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *