“শুধু তুমি থেকো পাশে”
দ্বিতীয় পর্ব
হৃদয়ের অচেনা ডাক
“তুমি কি শুনতে পাচ্ছো হৃদয়ের সেই অচেনা ডাক?”
অয়নের দিনগুলো এখন যেন অন্য ছন্দে বয়ে চলছিল।
গ্রামে আসার আগে সে ভাবত—ক’দিন কাটিয়ে আবার শহরে ফিরে যাবে, কিছুই বদলাবে না। কিন্তু মায়ার সঙ্গে পরিচয় সবকিছু পাল্টে দিল।
প্রতিটি ভোরে অয়ন হাঁটতে বের হলে কোথাও না কোথাও মায়াকে পাওয়া যেত। কখনও পুকুরপাড়ে খাতা হাতে, কখনও গাছতলায় গুনগুন করে গান গাইছে, আবার কখনও ছুটে যাচ্ছে স্কুলে। অয়নের চোখ বারবার তার দিকেই চলে যেত।
শুরুতে দুজনের কথাবার্তা ছিল ছোট ছোট—
“আজ স্কুলে কোন ক্লাস?”
“তুমি আবার কবে শহরে ফিরবে?”
“কালকের গানটা কেমন লাগল?”
কিন্তু ধীরে ধীরে সেই কথোপকথন গভীর হতে লাগল। মায়া অয়নের কাছে নিজের মনের কথা খুলে বলতে লাগল। সে জানাল, বাবা নেই অনেক বছর, মা সংসারের হাল ধরেছেন। বড় ভাই রূপম সংসারের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে অনেক সময় কড়া হয়ে ওঠে। মায়া নিজের স্বপ্ন লালন করে বাঁচে—একদিন নামী গায়িকা হবে, সবাই তাকে চিনবে।
অয়ন শুনত মুগ্ধ হয়ে। কখনও মনে হতো, সে যেন নিজের অচেনা এক দিক মায়ার চোখে খুঁজে পাচ্ছে। শহরে সে যতটা একলা থাকত, এখানে ততটাই কাছের কাউকে পেয়েছে।
এক বিকেলে মাঠের ধারে দুজনে পাশাপাশি বসে ছিল। ধানগাছের সবুজ ঢেউ, দূরে গরুর গাড়ি, আকাশে পাখির ঝাঁক—সব মিলিয়ে যেন ছবির মতো দৃশ্য।

মায়া বলল,
“অয়ন, তুমি এত চুপচাপ কেন? মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি কিছু বলতে চাও, কিন্তু বলো না।”
অয়ন একটু হেসে উত্তর দিল,
“শহরে সবাই বলে আমি কম কথা বলি। হয়তো সত্যিই তাই। কিন্তু তোমার সঙ্গে থাকলে মনে হয় অনেক কিছু বলার আছে… অথচ ভাষা খুঁজে পাই না।”
মায়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“আমিও না… তোমাকে না দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। অথচ আমরা তো একে অপরকে চিনি ক’দিন হলো?”
দুজনেই একে অপরের দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টি অনেক কথার চেয়েও গভীর ছিল।
দিনগুলো গড়াতে লাগল। গ্রামের রাস্তায় যখনই দুজন পাশাপাশি হাঁটত, অয়নের মনে হতো পুরো পৃথিবী যেন থেমে গেছে। আশেপাশে গ্রামের মানুষ মুচকি হেসে ফিসফিস করত—“পাশের বাড়ির শহুরে ছেলে আর আমাদের মায়া!”
প্রথমদিকে এ নিয়ে কেউ বেশি কিছু বলত না। কিন্তু ধীরে ধীরে কথাটা রূপ নিল গসিপে। একদিন মেলায় গিয়ে যখন অয়ন মায়ার জন্য কাচের চুড়ি কিনে দিল, তখন কয়েকজন যুবক মজা করে বলল,
“এই যে, শহরের দাদা, আমাদের গ্রামের মেয়েকে কবে নিয়ে যাচ্ছো?”
অয়ন অপ্রস্তুত হয়ে হেসে এড়িয়ে গেল। মায়ার গাল লাল হয়ে উঠল। ফেরার পথে মায়া মুখ ভার করে বলল,
“তুমি আবার এমন জিনিস কেন কিনে দিলে? লোকজন কত কথা বলছে।”
অয়ন চুপ করে কিছুক্ষণ ভেবেছিল। তারপর বলেছিল,
“মনে হলো এটা তোমার জন্যই বানানো। কাচের মতো, সরল আর রঙিন।”
মায়া আর রাগ করতে পারল না। চোখ নামিয়ে আস্তে বলল,
“তুমি মাঝে মাঝে এমন কথা বলো… যা আমাকে ভীষণ ছুঁয়ে যায়।”
তাদের প্রতিদিনের দেখা আর কথা বলা যেন এক অদ্ভুত অভ্যাসে পরিণত হচ্ছিল। অয়ন মায়ের কাজ সেরে বারান্দায় বসলে মায়া প্রায়ই ছাদ থেকে হাত নেড়ে ডাকত—
“চলো, মাঠে যাই।”
মাঝে মাঝে দুজনে বসত পুকুরপাড়ে। অয়ন কবিতা পড়ত, মায়া গান গাইত। একদিন অয়ন নিজের লেখা কিছু লাইন পড়ে শোনাল—
“তুমি হাওয়ার মতো এলেও,
আমি স্থির হয়ে থাকি—
তুমি হাসলেই মনে হয়,
জীবনটা নতুন করে দেখা বাকি।”
মায়া কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর মৃদু স্বরে বলল,
“অয়ন, তোমার চোখে আমি কে?”
প্রশ্নটা অয়নকে অবাক করল। সে তাকিয়ে বলল,
“তুমি? তুমি আমার কাছে সেই গান… যা না শুনলেও বাঁচা যায়, কিন্তু শুনলে মনটা অন্যরকম হয়ে যায়। তুমি আমার কাছে অপরিহার্য না, অথচ অপরিসীম।”
মায়ার চোখ চিকচিক করছিল। সে কিছু না বলে কেবল হাসল।

কিন্তু সবার কাছে এই বন্ধুত্ব ভালো লাগছিল না।
বিশেষ করে মায়ার বড় ভাই রূপম। সে একদিন অয়নকে আলাদা করে ডেকে বলল,
“শোনো, তুমি শহুরে ছেলে। ক’দিনের জন্য এখানে এসেছো, বুঝি। কিন্তু মায়ার সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ হয়ে যেও না। ও এখনো ছোট, ওর অনেক স্বপ্ন আছে। তোমরা যদি একে অপরকে ভুল বোঝো বা কষ্ট পাও, দায় কে নেবে?”
অয়ন চুপ করে শুনছিল। উত্তর দিল না।
সেই রাতে মায়া যখন ছাদে বসে গান গাইছিল, অয়ন দূর থেকে শুনছিল। মনে হচ্ছিল—এই সম্পর্কটা হয়তো সমাজের চোখে ব্যাখ্যা করা কঠিন, কিন্তু তার নিজের ভেতরে যে টান তৈরি হচ্ছে, সেটা কোনো যুক্তি মানে না।
অয়ন বুঝতে পারল—
এটা আর কেবল বন্ধুত্ব নয়।
এটা সেই অদৃশ্য টান, যা মানুষকে অচেনা থেকেও একে অপরের অপরিহার্য করে তোলে।
শরৎকাল তখন গ্রামে। চারদিকে সাদা কাশফুল দুলছে, নীল আকাশে তুলোর মতো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। মেলাবন্ধু হয়ে হাঁটতে হাঁটতে মায়া হঠাৎ বলল,
“জানো অয়ন, আমার মনে হয় আকাশটা আমাদের গল্প শুনছে।”
অয়ন হেসে বলল,
“তাহলে আকাশকেই সাক্ষী রাখি, আমরা যেন এই সময় কখনো ভুলে না যাই।”
মায়া চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর নরম স্বরে বলল,
“তুমি চলে গেলে… আমি একা হয়ে যাব।”
অয়নের বুক ধক করে উঠল।
“তুমি একা হবে না মায়া। আমি তো থাকব তোমার গানেই, তোমার হাসিতেই। যত দূরেই থাকি না কেন।”
মায়া চোখ নামিয়ে বলল,
“কিন্তু আমি চাই না তুমি শুধু মনে থাকো, আমি চাই তুমি পাশে থেকো।”

এই কথায় অয়ন আর কিছু বলতে পারল না। তার মনে হলো—এখন আর শব্দের দরকার নেই। দুজনের চোখে চোখ মিশেই যেন সব বলা হয়ে গেল।
একদিন সন্ধ্যায়, নদীর ধারে। সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। আকাশ লালচে রঙে রাঙা। দুজনে পাশাপাশি বসেছিল। মায়া চুপচাপ নদীর জলে পাথর ছুড়ছিল।
অয়ন জিজ্ঞেস করল,
“তুমি এত চুপচাপ কেন আজ?”
মায়া ধীরে বলল,
“জানি না… মনে হচ্ছে সময়টা খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। তুমি তো কয়েকদিনের জন্য এসেছো। তারপর আবার চলে যাবে।”
অয়ন একটু থেমে বলল,
“যদি বলি… আমি চাই না যেতে?”
মায়া অবাক হয়ে তাকাল। চোখ ভিজে উঠল।
“তুমি সত্যিই…?”
অয়ন আস্তে মাথা নাড়ল।
“তুমি না থাকলে আমি আবার সেই আগের অয়ন হয়ে যাব—একলা, নিস্তেজ। তুমি আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছো মায়া।”
মায়ার ঠোঁট কেঁপে উঠল। সে ফিসফিস করে বলল,
“অয়ন… তুমি জানো, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।”
অয়ন মুহূর্তে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বুকের ভেতর যেন ঢেউ খেলল। ধীরে ধীরে সে মায়ার হাতটা ধরল।
“আমিও মায়া… আমি তোমাকে ছাড়া ভাবতেই পারি না।”
দুজনের হাত এক হয়ে গেল। নদীর জলে সূর্যের শেষ আলো ঝিকমিক করছিল, আর সেই আলোতে জন্ম নিল এক নতুন অধ্যায়—বন্ধুত্ব থেকে প্রেমে পা ফেলা।
সেই রাতে আকাশে অসংখ্য তারা। বারান্দায় বসে অয়ন মনে মনে লিখল—
“অপরিচিত থেকে পরিচিত,
পরিচিত থেকে অচেনা টান,
আজ মনে হলো—
এই টানই আসলে ভালোবাসা।”
“হৃদয়ের অচেনা ডাক কি বদলে দেবে অয়ন–মায়ার পুরো জীবন? নাকি স্বপ্নের রঙে লুকিয়ে আছে অশ্রুর ছায়া? জানতে হলে পড়ুন পর্ব ৩ : স্বপ্নের রঙ।”
“তাদের সম্পর্কের আসল শুরুটা লুকিয়ে আছে সেই প্রথম দিনের গল্পে। আবেগ, ভালোবাসা আর অচেনা অনুভূতির আভাস পেতে হলে মিস করবেন না আগের অংশটা।
👉 [প্রথম পর্ব পড়ুন – ‘প্রথম দেখা’]”