হারানো প্রেম – এক জীবনের গল্প
সত্যিকারের প্রেম ভালোবাসা কখনো হারায় না, শুধু সময়ের অপেক্ষায় থাকে।”
শৈশবের প্রথম দেখা
১৯৭৭ সালের গ্রীষ্মের ছুটি। ক্লাস সেভেনের পরীক্ষা শেষ হতেই আমি বেড়াতে গিয়েছিলাম মামার বাড়ি। মামার বাড়ির একেবারে পাশেই ছিল পুরবীর মাসির বাড়ি। সেখানেই প্রথম আলাপ আমাদের।
বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে খেলতে খেলতে আমরা গাছে উঠতে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ পা ফসকে আমি নিচে পড়ে যাই। হাত-পা কেটে গেল, সারা শরীরে চোট লাগল। ব্যথা আর জ্বরে দুই দিন অস্থির হয়ে পড়েছিলাম।
আর ঠিক তখনই আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল পুরবী। সারাক্ষণ আমার যত্ন নিত—মাথায় জলপট্টি দিত, সময়মতো ওষুধ খাওয়াত, কখনো দূরে সরত না। তখন বুঝতে পারিনি, কিন্তু বাড়ি ফেরার পর থেকেই অদ্ভুত এক শূন্যতা গ্রাস করল আমাকে। শুধু পুরবীর মুখটাই চোখের সামনে ভাসত।
সেদিনই প্রথম বুঝেছিলাম, ভালো লাগা আসলে কাকে বলে।
প্রেমের সূচনা
কয়েক মাস পরে আবার দেখা হলো পুরবীর সঙ্গে। অনেক দ্বিধা, সংকোচ নিয়ে শেষমেশ মন খুলে নিজের অনুভূতির কথা বললাম। ভাবছিলাম, হয়তো সে কিছুই বলবে না। কিন্তু পুরবীর উত্তর আমাকে বিস্মিত করল।
সে হেসে বলল—
“তুমি যাওয়ার পর থেকেই আমি রাতে ঘুমোতে পারতাম না। বারবার মনে হতো, ওই দুর্ঘটনার পর তুমি কেমন আছো!”
তার যত্ন আর কথাগুলো শুনে বুঝলাম, সেও আমাকে মনে প্রাণে ভালোবেসেছে।
সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হলো আমাদের সম্পর্ক।
চিঠির মাধ্যমে চলতে লাগল যোগাযোগ। কাগজে লেখা ছোট্ট ছোট্ট শব্দের ভেতর লুকিয়ে থাকত অজস্র ভালোবাসা, স্বপ্ন আর অপেক্ষা। প্রতিটি চিঠিই যেন ছিল হৃদয়ের গোপন ডায়েরির পৃষ্ঠা।
কিন্তু সুখ বেশিদিন টিকল না। পুরবীর বাবা ছিলেন খুবই রাগী ও কঠোর মানুষ। একদিন ভুলবশত আমাদের একটি চিঠি তার হাতে পড়ে গেল। সেই থেকেই শুরু হলো অশান্তি আর ভয়ের দিনগুলো। তবুও আমরা আঁকড়ে ধরে রেখেছিলাম আমাদের ভালোবাসাকে।
আকস্মিক ভাঙন
দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল আশা আর আশঙ্কার দোলাচলে। হঠাৎ একদিন খবর পেলাম—এক বছর আগেই পুরবীর বিয়ে হয়ে গেছে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে।
খবরটা শোনার মুহূর্তেই যেন মাথায় বাজ পড়ল। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল, পৃথিবীটা যেন থেমে গেল এক ঝটকায়। এতদিন যাকে স্বপ্নে বেঁধে রেখেছিলাম, হঠাৎ সে চলে গেল অন্য এক জীবনের পথে।
অসহায় মন নিয়ে একদিন সাহস করে গিয়েছিলাম পুরবীর বাড়িতে। সেখানে দেখা হলো তার মায়ের সঙ্গে। আমাকে দেখেই তিনি যেন সব বুঝে ফেললেন। মমতাভরা চোখে বললেন—
“বাবা, পুরবী তোমাকে ছেড়ে যেতে চায়নি। আজও তোমার নাম করে কাঁদে। কিন্তু তার বাবার জেদে কিছুই করা যায়নি। তোমার চিঠি পাওয়ার পর থেকেই তিনি রাগে তোমার খোঁজ করছিলেন। অবশেষে সুযোগ পেয়ে জোর করেই বিয়ে দিয়ে দিলেন। তুমি পুরবীকে ভুলে যাও বাবা… ও এখনও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে।”
কথাগুলো শুনে বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। তবুও মনটা অদ্ভুতভাবে শান্তও হলো—কারণ বুঝলাম, পুরবী সত্যিই আমায় ভালোবাসত।
কিন্তু আমাদের প্রেমের পথ সেখানেই শেষ হয়ে গেল।
নিঃসঙ্গ বার্ধক্য
সময় বয়ে চলে নিজের নিয়মে। পুরবীর সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টেনে আমি পারিবারিক ব্যবসায় মন দিলাম, সংসার করলাম। স্ত্রী, দুই ছেলে আর তিন মেয়ে নিয়ে আমার জীবন যেন আবার নতুন পথে হাঁটতে শুরু করল।
কিন্তু সুখের সেই দিন বেশিদিন স্থায়ী হলো না। বছর কেটে গেল, সন্তানরা বড় হলো, সংসার আলাদা করল। সাত বছর আগে আমার স্ত্রীও চিরবিদায় নিলেন।
এরপর থেকেই বাড়ির চার দেয়ালে আমি হয়ে গেলাম নিঃসঙ্গ এক মানুষ।
দুই ছেলে নিজেদের সংসারে ব্যস্ত, মেয়েরা দূরের শহরে। নাতি-নাতনিদের সঙ্গে কথা বললে মনে হতো, যেন ওদের মায়েরা বিরক্ত হয়। আস্তে আস্তে আমি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়লাম আপন ঘরেই।
এরই মাঝে শরীরও ভেঙে পড়তে শুরু করল—ছোটখাটো অসুখ-বিসুখ নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়াল। একদিন সন্ধ্যায় হালকা বৃষ্টির মধ্যে বড় ছেলে আর ছোট ছেলে মিলে বলল—
“বাবা, আমরা বুঝতে পারছি তোমার কষ্ট হচ্ছে। আমাদের পক্ষে তোমার যত্ন নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কাছেই একটা আশ্রম আছে, যদি আপত্তি না থাকে, সেখানে তোমাকে রাখলে তুমি ভালো থাকবে। প্রয়োজনে আমরা দেখতে আসব।”
কথাগুলো শুনে বুকটা কেঁপে উঠল। গলায় যেন কিছু আটকে গেল। চোখ ভিজে উঠল জলে।
কিছুই বললাম না—শুধু নীরবে রাজি হয়ে গেলাম।
এরপর রবিবারেই তারা আমাকে রেখে এল বৃদ্ধাশ্রমে—“শান্তি নীড়”-এ।
প্রথম দু’দিন ঘর থেকে বেরোতে পারিনি। ভীষণ ভারাক্রান্ত মন, মনে হচ্ছিল—জীবনটা যেন হঠাৎ করে সব আলো হারিয়ে ফেলেছে।
আশ্রমে পুনর্মিলন
“শান্তি নীড়”-এর দিনগুলো ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছিল। প্রথম দু’দিন কারও সঙ্গে কথা বলিনি, শুধু একা ঘরে বসে থেকেছি। মনটা এতটাই ভারাক্রান্ত ছিল যে মনে হচ্ছিল, জীবনের শেষ অধ্যায়টা হয়তো নিঃসঙ্গতাকেই সঙ্গী করে কাটাতে হবে।
তৃতীয় দিনের সকালে একটু সাহস করে আশ্রমের উঠোনে বেরোলাম। হালকা রোদ, বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ। সামনের বাঁধানো গাছের নিচে বসে চারপাশ দেখছিলাম। ঠিক তখনই চোখে পড়ল—একজন প্রবীণা মহিলা দূর থেকে আমার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে আছেন।
আমি হেসে বললাম—
“কি দেখছেন? আমি কিন্তু এখানে নতুন এসেছি। তিনদিন হলো এসেছি।”
আমার কথা শেষ হতেই তিনি আচমকা দৌড়ে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। এত বছর পর এমন করে কেউ আমাকে বুকে টেনে নেয়নি। অবাক হয়ে হাত সরিয়ে মুখটা দেখতে গেলাম—
আর তখনই যেন বুকের ভেতর ঝড় বয়ে গেল।
সে তো পুরবী!
আমার শৈশবের সেই ভালোবাসা, হারানো প্রেম!
চোখ ভিজে উঠেছিল দুজনেরই। কোনো কথা নয়, শুধু কান্নার জলে মিলেমিশে যাচ্ছিল বহু বছরের বেদনা।

কিছুক্ষণ পর পুরবী মৃদু কণ্ঠে বলল—
“আমার স্বামী বহু বছর আগে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। আমার একমাত্র মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। তাই নিজের সংসারে আর জায়গা হয়নি আমার। চার বছর হলো আমি এই আশ্রমেই আছি।”
আমরা দু’জন বসে রইলাম সেই গাছতলায়—কথার বদলে ভেসে উঠল শুধু স্মৃতির স্রোত। মনে হচ্ছিল, সময় যেন হঠাৎ পেছনে ফিরে গেছে।
জীবনের শেষ প্রহরে নতুন শুরু
পুরনো প্রেমিক-প্রেমিকার পুনর্মিলনের খবর যেন আশ্রমের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে পড়ল। বয়স্ক মানুষগুলো, যাদের দিন কেটে যায় স্মৃতি আর নিঃসঙ্গতায়, তারাও যেন নতুন করে আলো দেখতে পেল। সবাই অবাক হয়ে দেখছিল—কীভাবে দু’জন মানুষ, যাদের জীবনের সেরা সময় কেটে গেছে আলাদা পথে, বার্ধক্যে এসে আবার একে অপরের হাত ধরে পথ চলা শুরু করেছে।
আশ্রমের সবাই এগিয়ে এল, তাদের চোখেমুখে খুশি। কেউ মজা করে বলল—
“দেখেছো! সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো মরে না।”
কেউ আবার ফিসফিস করে বলল—
“এমন দৃশ্য তো সিনেমাতেও খুব একটা দেখা যায় না।”
কর্তৃপক্ষ ও অন্য আবাসিকরা মিলে ঠিক করলেন—এই দু’জনকে আবার বিয়ে দেওয়া হবে। দিন-তারিখ ঠিক হলো। আশ্রমের উঠোনে সাধারণ সাজসজ্জা করা হলো—কয়েকটা গাঁদা ফুলের মালা, কলাপাতা দিয়ে ছোট্ট মঞ্চ। কোনো জাঁকজমক নেই, নেই উল্লাসের ভিড়—কিন্তু চারপাশে ভাসছে অদ্ভুত এক আবেগ, এক শান্ত আনন্দ।
সেদিন আশ্রমের সকলের আশীর্বাদে আবার মিলিত হলো দুটি হারানো প্রাণ। পুরবীর চোখ ভিজে উঠেছিল, আমারও বুক ভরে এসেছিল অশ্রুজলে। মনে হচ্ছিল—এ যেন নতুন করে জন্ম নেওয়া।
তারপর থেকে আশ্রমে আমাদের জন্য আলাদা একটি ঘর দেওয়া হলো। ঘরটা ছোট, কিন্তু তাতেই আমাদের পৃথিবী। সকালে একসঙ্গে হাঁটি বাগানে, চায়ের কাপে ভাগাভাগি করি দিনের প্রথম আলো। বিকেলে একসাথে বসি গাছতলায়, পুরনো দিনের কথা বলি—সেই চিঠিগুলোর কথা, হারানো সময়ের কথা, আর অগণিত অপূর্ণ স্বপ্নের কথা।
রাতে যখন ঘুমিয়ে পড়ি, মনে হয়—এই হাতটা হয়তো আর কোনোদিন ছাড়ব না।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে আমরা খুঁজে পেয়েছি আমাদের হারানো সুখ, আমাদের সত্যিকারের প্রেম।
আজ বুঝতে পারি—
ভালোবাসা আসলে কোনো বয়স মানে না। সত্যিকারের প্রেম কখনো মুছে যায় না, শুধু অপেক্ষা করে থাকে সঠিক মুহূর্তের জন্য।