"সহানুভূতির আলো"
|

সহানুভূতির আলো

সহানুভূতির আলো – এক মানবিক সম্পর্কের অনুপ্রেরণামূলক গল্প

রহস্যময় ছদ্মবেশ

শহরের কোলাহলের মধ্যে, এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল ধুলো-মাখা, পুরোনো জামা পরা এক যুবক। হাতে একটি ছেঁড়া ব্যাগ, চোখে ক্লান্তি, মুখে অভাবের ছাপ—দেখতে যেন বছরের পর বছর কষ্টে কাটানো একজন গরিব ভিখারি।
ভোরের প্রথম আলোতে মানুষজন যখন তাড়াহুড়ো করে কাজে বেরোচ্ছে, তখন সে চুপচাপ সবার কাছে খাবার চাইত। অধিকাংশ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিত, কেউ বিরক্তি নিয়ে তাকাত, আবার কেউ দ্রুত হেঁটে চলে যেত যেন কিছু শুনতেই পায়নি।

কিন্তু এই চেহারা ছিল কেবল এক মুখোশ।
আসলে তিনি ছিলেন অদ্বৈত সেন—এক সময়ের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর একমাত্র পুত্র। কয়েক মাস আগে তার বাবা রহস্যজনকভাবে খুন হন। পুলিশের তদন্ত চললেও অপরাধীদের পরিচয় অজানা রয়ে যায়। অদ্বৈত জানতেন, এই হত্যার পেছনে আছে বড়সড় চক্র, আর সত্য উদঘাটনের একমাত্র উপায় হল সরাসরি রাস্তায় নেমে, মানুষের আসল চেহারা দেখা।

তাই তিনি নিজের পরিচয় গোপন করে গরিব ভিখারির ছদ্মবেশ নিলেন। আর সেই ছদ্মবেশেই দিনের পর দিন কাটাতে লাগলেন, যাতে অপরাধীদের গতিবিধি, তাদের লুকানো খবর আর শহরের অন্ধকার দিক সরাসরি চোখে পড়ে।

তবে তিনি জানতেন না, এই ছদ্মবেশী জীবন একদিন তাকে শুধু বাবার হত্যাকারীদের কাছেই নয়, বরং এমন একজনের কাছেও নিয়ে যাবে, যে তার জীবন আলো বদলে দেবে চিরদিনের জন্য…

মানবিক হাত

অদ্বৈতের ছদ্মবেশী দিনগুলো একঘেয়ে চলছিল। প্রতিদিন ভোরে আলোতে সে একই জায়গায় দাঁড়াত, মানুষের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে থাকত, আর অপেক্ষা করত কেউ হয়তো দয়া করে একমুঠো খাবার দেবে।
বেশিরভাগ সময়ই ফলাফল হত একই—অবহেলা, ঠান্ডা দৃষ্টি, বা বিরক্তি।

কিন্তু এক সকালে ঘটল অন্য কিছু।
কলেজের ইউনিফর্ম পরা, কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো এক তরুণী তার পাশে এসে দাঁড়াল। হাতে ছোট্ট এক প্যাকেট খাবার বাড়িয়ে দিয়ে বলল—
“খেয়ে নিন দাদা, সারাদিন না খেয়ে থাকা ভালো নয়।”

অদ্বৈত প্রথমে কিছু বললেন না। অপরিচিত কেউ বিনা কারণে সাহায্য করছে—এমন ঘটনা তার জন্য বিরল ছিল।
তরুণীর মুখে ছিল মায়া, চোখে আন্তরিকতা। কোনো করুণা নয়, বরং মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ যেন ঝরে পড়ছিল তার আচরণে।

সেদিনের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই সেই মেয়েটি, যার নাম পরে অদ্বৈত জানতে পেরেছিলেন শ্রেয়া, কলেজে যাওয়ার পথে তার হাতে খাবার দিয়ে যেত।
“আজ ভাত আর ডাল, কাল হয়তো পাউরুটি। যা পেয়েছি, তাই দিলাম,”— হাসিমুখে বলত সে। তার মুখের হাসিতে যেন আলো ঝরছে।

অদ্বৈত বুঝতে পারলেন, শহরের ঠান্ডা দুনিয়াতেও কিছু উষ্ণ হৃদয় আছে। শ্রেয়ার দেওয়া সামান্য খাবার যেন শুধু পেট নয়, তার মনও ভরিয়ে দিত।
আর অদ্বৈতের মনে এক অদ্ভুত কৌতূহল জন্মাল—এই মেয়েটির জীবন কেমন? কী তাকে এত সহানুভূতিশীল করেছে?

তখনও তিনি জানতেন না, অচিরেই এই মানবিক হাত তার নিজের জীবনেই অমূল্য আলোর ছোঁয়া দিতে চলেছে…

কণ্ঠে আতঙ্ক

সকালের হালকা কুয়াশায় ঢাকা রাস্তা দিয়ে অদ্বৈত তার নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়ালেন। অভ্যাসমতো চোখ খুঁজছিল শ্রেয়াকে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সে এল—কিন্তু আজ তার মুখে সেই পরিচিত আলো ঝলমলে হাসি নেই। চোখের নিচে কালচে দাগ, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, আর হাঁটার ভঙ্গিতে এক অদ্ভুত তাড়াহুড়ো।

অদূরে দাঁড়িয়ে শ্রেয়াকে ফোনে কথা বলতে শুনলেন অদ্বৈত। তার কণ্ঠ কাঁপছে—
“মা, আমি টাকা জোগাড় করব… যেখান থেকেই হোক… তুমি শুধু কেঁদো না…”

অদ্বৈতের মনে ধাক্কা লাগল। প্রতিদিন যাকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখেছেন, আজ তার চোখে জল, কণ্ঠে ভয়।
তিনি কাছে গিয়ে ধীরে জিজ্ঞেস করলেন—
— “কী হয়েছে? কোনো বিপদ নাকি?”

শ্রেয়া একটু ইতস্তত করে, যেন নিজের দুঃখ প্রকাশ করতে লজ্জা পাচ্ছে, বলল—
“বাবা খুব অসুস্থ। ডাক্তার বলেছেন, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে… কিন্তু আমাদের সামর্থ্য নেই। আমি জানি না কী করব…”

কথাগুলো শেষ করে সে তাড়াতাড়ি খাবারের প্যাকেট বাড়িয়ে দিল, যেন নিজের কষ্ট আড়াল করতে চাইছে।
অদ্বৈত খাবার নিলেন, কিন্তু মনে হলো যেন সেই প্যাকেটের ওজন আজ অনেক বেশি—ভারি হয়েছে শ্রেয়ার উদ্বেগে, অসহায়তায়।

তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন—আজ এই মেয়েটির জীবন থেকে অন্তত একটি কষ্ট তিনি মুছে দেবেন।

নীরব সহায়তা

শ্রেয়ার কষ্টের কথা শোনার পর অদ্বৈত আর এক মুহূর্তও দেরি করলেন না।
তিনি শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন—
— “তোমাদের বাড়ি কোথায়?”

শ্রেয়া ঠিকানা বলতেই, কোনো বাড়তি কথা না বলে অদ্বৈত মাথা নাড়লেন।
পরের মুহূর্তে তিনি ভিড়ের আড়ালে সরে গিয়ে নিজের পকেট থেকে ছোট্ট একটি স্মার্টফোন বের করলেন—যেটা সাধারণত তিনি ছদ্মবেশে ব্যবহার করতেন না।
দ্রুত নম্বর টিপে তার ব্যক্তিগত সহকারীকে বললেন—
“এই ঠিকানায় পৌঁছে লোকটির বাবাকে শহরের সেরা হাসপাতালে ভর্তি করাও। বিলের চিন্তা করবে না—সব আমার দায়িত্ব।”

দু’ঘণ্টার মধ্যে শহরের বড় হাসপাতালে শ্রেয়ার বাবাকে ভর্তি করা হলো। সেরা ডাক্তাররা চিকিৎসা শুরু করলেন, প্রয়োজনীয় সব ওষুধ আনা হলো।
হাসপাতালের ক্যাশ কাউন্টারে দাঁড়ানো শ্রেয়া অবাক হয়ে শুনল—
— “সমস্ত বিল ইতিমধ্যেই পরিশোধ করা হয়েছে।”

সে চারপাশে তাকাল—কে করল এই সাহায্য? কেউ নাম জানাল না, শুধু বলল—
— “একজন ভদ্রলোক আগেই সব ব্যবস্থা করে গেছেন।”

শ্রেয়ার চোখ ভিজে উঠল।
যে মানুষটির মুখ সে পর্যন্তও জানে না, সে তার জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদে এগিয়ে এল—কোনো পরিচয় না দিয়ে, কোনো প্রতিদান আশা না করে।
তার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—যে-ই হোক, তাকে খুঁজে বের করে ধন্যবাদ জানাবেই।

সত্য উদঘাটন

হাসপাতালের প্রার্থনাকক্ষে বসে চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিল শ্রেয়া।
তার বাবার অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল, ডাক্তাররা বলছেন সময়মতো ভর্তি করায় বিপদ কেটে গেছে।
তবু শ্রেয়ার মন অস্থির—কে এই অদৃশ্য সহায়ক? কেন সে নিজের পরিচয় গোপন রেখেছে?

ঠিক তখনই তার মা এসে কাঁপা গলায় বললেন—
“মা, বাইরে একজন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। উনিই নাকি তোমার বাবার সমস্ত খরচ দিয়েছেন।”

শ্রেয়া তাড়াতাড়ি করিডোর দিয়ে বাইরে এল।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক—কিন্তু এ যেন সম্পূর্ণ অপরিচিত চেহারা।
পরিপাটি স্যুট, চকচকে জুতো, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি… আর সেই চোখ—যেন কোথাও আগে দেখা।

শ্রেয়া বিস্ময়ে বলল—
— “আপনি… আপনি তো সেই…”

যুবক মৃদু হেসে বললেন—
— “হ্যাঁ, আমি-ই সেই গরিব ভিখারি… তবে সেটি ছিল কেবল ছদ্মবেশ। আমার নাম অদ্বৈত সেন।”

"সহানুভূতির আলো"

শ্রেয়া নির্বাক।
অদ্বৈত শান্ত কণ্ঠে বললেন—
— “তুমি আমার অতীত না জেনে, কোনো লাভের আশায় নয়, শুধু মানবিকতার জন্য সাহায্য করেছ। তোমার মতো মানুষ আছে বলেই এই পৃথিবী টিকে আছে। আমি জানি, তোমার এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না… কিন্তু অন্তত তোমাকে জানাতে চেয়েছিলাম, তোমার দেওয়া খাবার শুধু আমার ক্ষুধাই মেটায়নি—আমাকে মনে করিয়েছে, এখনও ভালো মানুষ আছে।”

শ্রেয়ার চোখে জল চলে এল।
আজ সে বুঝল, কিছু সাহায্য কেবল একজন মানুষের জীবন নয়, তার মনও বদলে দেয় চিরদিনের জন্য।

নতুন সূচনা

অদ্বৈতের কথাগুলো শ্রেয়ার হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
যে মানুষটির কাছে সে প্রতিদিন সামান্য খাবার দিয়েছে, সেই মানুষটিই আজ তার বাবার জীবন বাঁচিয়েছে—এ যেন কোনো গল্পের মতোই অবিশ্বাস্য।

কয়েক দিন পর, শ্রেয়ার বাবার সুস্থতার পর অদ্বৈত তাদের বাড়িতে এলেন। সঙ্গে ছিলেন তার মা।
অদ্বৈতের মা স্নেহভরে শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন—
“তুমি আমাদের ছেলের জন্য অনেক কিছু করেছ, মেয়ে। আজ আমরা তোমাকে আরেকটি সম্পর্কের প্রস্তাব দিতে এসেছি।”

শ্রেয়ার বাবা–মা একে অপরের দিকে তাকালেন। অদ্বৈত সরাসরি বললেন—
— “আমি শ্রেয়াকে বিয়ে করতে চাই, যদি আপনারা সম্মতি দেন।”

শ্রেয়া হতবাক। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর, বাবা–মা হাসিমুখে মাথা নাড়লেন।
“তোমার মতো একজন মানুষের হাতে আমাদের মেয়েকে তুলে দিতে আপত্তি নেই,”— বললেন শ্রেয়ার বাবা।

এরপর ছোট্ট এক অনুষ্ঠানেই তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন।
শহরের সেই রাস্তায়, যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল, তারা আবারও একদিন হাঁটলেন—তবে এবার আর গরিব ভিখারি ও কলেজছাত্রী হিসেবে নয়, বরং স্বামী-স্ত্রী হিসেবে, হাতে হাত রেখে।

অদ্বৈতের ছদ্মবেশের যাত্রা শেষ হলেও, সেই যাত্রা তাকে দিয়েছে জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি—ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা আর একটি নতুন সূচনা।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *