প্রেম: ঝাল না মিষ্টি?
পাঁপড়-ঘুগনি আর প্রথম দেখার দুপুর
“কলেজ স্ট্রিটের ভিড়ে শুরু হওয়া প্রেম—শেষটা কি হবে মিষ্টি, নাকি তিক্ত?” জানতে হলে পড়ুন আজকের গল্প……
কলকাতার গ্রীষ্ম দুপুরে বইপাড়া কলেজ স্ট্রিট যেন এক চলমান নাট্যমঞ্চ। বাঁধানো রাস্তার ধারে ধারে বইয়ের দোকান, সাদা-কালো জামায় মোড়া ছাত্রছাত্রী, আর তারই মাঝে লেগে থাকা চায়ের ধোঁয়া আর কাগজে মোড়ানো চানাচুরের গন্ধ।
সেইদিন অনীক এসেছিল ক্লাসের পর বাংলা সাহিত্যর এক পুরনো সংস্করণ খুঁজতে। হঠাৎ করেই চোখ আটকে গেল এক ফুচকা-ঘুগনির ঠেলাগাড়ির সামনে।
তৃণা।
মেয়েটি পাঁপড়-ঘুগনি হাতে নিয়ে দোকানদারকে বলছিল,
— “ঝালটাও একটু বেশি দেবেন, কিন্তু শেষে এক চামচ মিষ্টি জল দেবেন। না হলে মজা জমবে না।”
অনীকের কানে এই কণ্ঠস্বরটা যেন ধরা পড়ল রেডিওর পুরনো প্রিয় গানের মতো। একবার তাকিয়ে থাকল, তারপর আবার। মেয়েটির মুখে ছিল অনায়াস হাসি, যেন রোদে শুকনো জামার মতো হালকা, প্রাণবন্ত।
“তুমি কী ঝাল খাও?”
হঠাৎ করেই মেয়েটি অনীককে জিজ্ঞেস করল, যেন তাকে চেনেই বহুদিন।
অনীক একটু চমকে গিয়ে বলল,
— “হ্যাঁ… তবে অতটা না, মাঝে মাঝে লাগে গলা।”
তৃণা হেসে বলল,
— “তাহলে জীবনেও ঝাল কম লাগে বুঝি?”
দুজনে একসঙ্গে হেসে ফেলল।
একটু পরে, ঠেলাগাড়ির পাশে দাঁড়িয়েই তারা দু’জনে ভাগ করে খেল এক বাটি ঘুগনি—ঝাল-মিষ্টি মিশ্রণ। যেন জীবনের প্রথম পরশ।
বইয়ের দোকানে যাওয়া আর হল না সেদিন। অনীক বুঝল, একটা নাম, একটা হাসি, আর এক বাটি ঘুগনি তার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে দিল।
নামটা জানতেই দুইদিন কেটে গেল
সেই প্রথম দিনের ঘুগনি ভাগ করে খাওয়ার পর, অনীকের মন থেকে তৃণার হাসিটা কিছুতেই সরছিল না। ক্লাসে বই খুলে রাখলেও পাতার বদলে মাথার ভেতর শুধু সেই কণ্ঠস্বর, “জীবনেও ঝাল কম লাগে বুঝি?”
পরের দিন, একই সময়ে, কলেজ স্ট্রিটের সেই রাস্তায় আবার গেল অনীক। কিন্তু আজ ঠেলাগাড়ির পাশে তৃণা নেই। সে এল না।
তৃতীয় দিন সে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করল। প্রতিটা ঘন্টা যেন চায়ের কাপের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক বিকেল, বিক্রেতা বলল,
— “কাল একটা মেয়ে আপনাকে খুঁজছিল, চোখে চশমা, মুখে সবসময় হেসে…”
অনীকের হৃদয় যেন একলাফে মস্ত রোদে গিয়ে নামল।
— “আবার আসবে?”
— “বলল কাল আসবে ঠিক। সময়টাও বলল – দুপুর দুইটা।”
পরের দিন, বেলা একটা পঁইত্রিশে অনীক পৌঁছে গেল, বুকের ভিতর ধুকপুকানি নিয়ে।
ঠিক দুইটায় এল তৃণা—হাতের ফোনে কিছু একটা দেখে হেসে বলল,
— “এত আগেই চলে এসেছো? আমি ভাবছিলাম, তুমি আর আসবে না।”
অনীক একটু মাথা চুলকে বলল,
— “আসব না? আমি তো দুইদিন ধরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে সানগ্লাস গুনছিলাম, যদি চেনা মুখ দেখি!”
তৃণা হেসে ফেলল।
— “আচ্ছা, এত কথা বললেও নামটা কিন্তু আমি তখন বলিনি, ঠিক?”
অনীক চোখ ছোট করে বলল,
— “তুমিও বলোনি। কেমন লুকোচুরি খেলা যেন!”
তৃণা একটু পাঁপড় তুলে মুখে দিয়ে বলল,
— “তৃণা। এখন বলো, তুমি?”
— “অনীক।”
দুজনে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তখন রাস্তার পাশ দিয়ে একটা বাচ্চা ছেলে গেল, খালি গায়ে, ঘাড়ে একটা স্কুলব্যাগ।
তৃণা তাকিয়ে বলল,
— “এই শহরে হাজার গল্প, কিন্তু কিছু গল্প হয়তো শুরুই হয় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘুগনি খেতে খেতে।”
অনীক হেসে বলল,
— “আমাদের মতো?”
তৃণা একটু ভেবে বলল,
— “হয়তো… কিন্তু মনে রেখো, প্রতিটা প্রেমের গল্পেই নাম জানার আগে থাকে চোখে চোখ রাখা।”
আর সে চোখ রাখা দুপুরটা তাদের গল্পের প্রথম অফিসিয়াল অধ্যায় হয়ে গেল।
প্রেম ঝালও, মিষ্টিও
কলেজ স্ট্রিটের সেই ঘুগনি-ঠেলাটা যেন এখন তাদের নির্দিষ্ট ঠিকানা হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন ঠিক দুপুর দুটোয় দেখা—তৃণার হাতে বইয়ের ব্যাগ, অনীকের পকেটে পকেটখাতা আর পেন।
তাদের গল্পের শুরুটা ছিল যেমন ঘুগনির ঝাল-মিষ্টির মতো, সম্পর্কটাও ঠিক সেরকম। কখনও তৃণার হাসি, কখনও অনীকের চুপচাপ বসে থাকা, কখনও হঠাৎ রাগ, তো কখনও গলাভরা অভিমান।
একদিন ফুচকা খেতে খেতে তৃণা বলল,
— “তুমি জানো, প্রেম মানেই শুধু হাতে হাত ধরা নয়। কখনও কখনও চোখের রাগটাও প্রেমের ভাষা হয়।”
অনীক একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
— “তুমি সবকিছু এত গভীরভাবে ভাবো কী করে?”
তৃণা চট করে উত্তর দিল,
— “কারণ আমি ঝাল ঘুগনি খাই, শুধু মিষ্টি খেলেই তো মন বোঝে না!”
হাসতে হাসতেই তৃণা একদিন চুপ করে গেল।
— “তুমি মন খারাপ করেছো?”
— “না… মানে একটু… আমার মা বলে, এইসব বন্ধুত্বে একসময় মন জড়িয়ে যায়। আর মন ভাঙলে খুব কষ্ট হয়।”
অনীক চুপ করে রইল। বাতাসে তখন বৃষ্টির গন্ধ। ধুলোবালি উড়ছে, ছাতা নেই কারও কাছে।
বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে অনীক বলল,
— “তৃণা, জানো… আমি জানি প্রেম শুধু হাসির গল্প না, মাঝেমাঝে চোখের জলও পড়ে। তবু, আমি চাই, যদি ঝাল-মিষ্টির মাঝে কিছু একটা সত্যি থাকে… তাহলে সেটা তুমিই হও।”
তৃণা কিছু বলল না। শুধু ছাতাহীন বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে তার চোখ দুটোতে তখন হালকা জল—জানা নেই বৃষ্টির না আবেগের।
পরের কিছুদিনে তাদের বন্ধুত্ব এক নতুন রূপ নিল। ক্লাসের ফাঁকে বইয়ের ভাঁজে ছোট চিরকুট, পকেটবুকের মাঝে কবিতা, ফোনে মিসকল দিয়ে ‘আজ দেখা হবে তো?’ জানানো—সব মিলিয়ে যেন কলকাতার গলি গলি প্রেম ছড়িয়ে পড়ছে।
কিন্তু তৃণা মাঝে মাঝে হঠাৎ চুপ হয়ে যেত। বলত,
— “তুমি খুব ভালো। কিন্তু আমি জানি না, ভালোবাসা মানে ঠিক কী!”
অনীক তখন শুধু বলত,
— “ভালোবাসা মানে হয়তো জানার দরকার নেই… শুধু তুমি পাশে থাকো, বাকি আমি বুঝে নেব।”
একদিন ঝগড়া, আর এক বাটি ঝাল ঘুগনি
সেই দিনটাও শুরু হয়েছিল অন্য সব দিনের মতোই। দুপুরের আলসেমি কাটিয়ে কলেজ স্ট্রিটে দেখা, তৃণার মুখে চেনা হাসি, আর অনীকের হাতে সস্তা কবিতার বই।
কিন্তু সেদিন কথার ভিতরেই যেন কোথা থেকে একটা তিক্ততা ঢুকে পড়েছিল।
তৃণা বলল,
— “তুমি তো প্রতিদিনই আমাকে সময় দাও, কিন্তু কোনদিন আমার কথা মন দিয়ে শোনো কি?”
অনীক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
— “মানে? আমি তো প্রতিদিন তোকে দেখছি, কথা বলছি…”
তৃণার কণ্ঠ একটু চড়া হয়ে উঠল,
— “দেখা মানেই তো মন দেওয়া না! আমি যখন ভবিষ্যতের কথা বলি, তুমি হেসে উড়িয়ে দাও। তুমি বুঝতেই চাও না, আমি কবে বাড়ি ফিরে যাব, কী করব, কোথায় চাকরি পাব। এই শহর তো শুধু প্রেম দিয়ে চলে না, অনীক!”
অনীক থমকে গেল।
— “তুমি তাহলে এসব আগে বলোনি কেন?”
তৃণা চোখ নামিয়ে বলল,
— “কারণ আমি ভাবছিলাম, তুমি নিজে থেকেই বুঝবে। কিন্তু তুমি শুধু এখন নিয়ে ভাবো, ভবিষ্যৎ নিয়ে না।”
এক অদ্ভুত নিঃশব্দে ছেয়ে গেল চারপাশ।
তৃণা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল,
— “আমি আজ যাচ্ছি। যদি কখনও বুঝতে পারো, প্রেম মানে শুধু আজ না, কালকেও সামলাতে হয়… তখন এসো।”
চলে গেল।
অনীক ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। সেই ফুচকার ঠেলাগাড়িটা, সেই ঘুগনির হাঁড়ি, সবকিছু তখন অনীকের চোখে ঝাপসা হয়ে গেল।
পরের দিন
অনীক সোজা গিয়ে দাঁড়াল সেই দোকানের সামনে। দোকানদার বলল,
— “দিদিমণি তো এল না আজ।”
অনীক বলল,
— “এক বাটি ঘুগনি দিন। আজ বেশি ঝাল দেবেন।”
দোকানদার অবাক,
— “আপনি তো ঝাল কম খেতেন!”
— “আজ একটু বেশি লাগুক… মনও তো ঝাল খাচ্ছে।”
অনীক একাই বসল। সেই বেঞ্চে। তৃণার পাশে আজ কেউ নেই, পাশে সে নিজেও নেই।
মাঝে মাঝে কিছু প্রেম টিকিয়ে রাখতে গেলে একটুখানি দূরত্ব দরকার হয়ে যায়—যেন বোঝা যায়, কার অভাব কাকে কতটা নাড়িয়ে দেয়।
প্রেমের রেসিপি
দু’দিন, তিন দিন… এক সপ্তাহ।
তৃণা আর আসেনি।
অনীক প্রতিদিন সেই ঘুগনির দোকানে যেত, বসে থাকত চুপচাপ। দোকানদারও আর কিছু জিজ্ঞেস করত না, শুধু এক বাটি ঘুগনি সামনে দিয়ে দিত, অতিরিক্ত ঝাল ছাড়া।
একদিন বিকেলে, বৃষ্টির ঠিক আগে-আগে, হঠাৎ ঝড়ের হাওয়া উঠতেই একটা কাগজ উড়ে এসে অনীকের পায়ে পড়ল। সে কাগজটা তুলেই দেখল… একটি চিরকুট।
হাতে লেখা –
“ঘুগনিতে ঝাল থাকতেই হয়, তবেই তো শেষে মিষ্টি জলের স্বাদটা বোঝা যায়। আমি প্রতিদিন আসতাম, তুমি চোখ তুলে তাকাওনি… আজ তাকাবে?”
চোখ তুলে দেখে, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে তৃণা।
ভেজা চুল, চোখে কাচভাঙা আলোর মতো ভেজা দৃষ্টি।
অনীক উঠে দাঁড়াল।
— “তুমি ফিরে এলে?”
— “তুমি তো আমার অপেক্ষা করছিলে… রেসিপিটা বুঝে গেছো?”
অনীক হেসে বলল,
— “প্রেমে এক চামচ ঝাল, এক চামচ মিষ্টি, মাঝখানে অভিমান আর শেষে একটু করে ক্ষমা। এই হচ্ছে প্রেমের রেসিপি, তাই তো?”

তৃণা বলল,
— “আর সব রেসিপির মতো, প্রেমকেও সময় দিতে হয়। নাড়াচাড়া করতে হয়, অপেক্ষা করতে হয়, তবেই তো খাওয়া যায় মন দিয়ে।”
সেদিন তারা আবার ভাগ করে খেল এক বাটি ঘুগনি—এইবার অনীকের হাতে দেওয়া, তৃণার পছন্দ মতো মেশানো।
ঝালও ঠিক, মিষ্টিও ঠিক।
বছর তিনেক পর, অনীক আর তৃণা একসঙ্গে একটা ছোট ক্যাফে খোলে – নাম দেয় “ঘুগনি & গল্প”।
মেনুতে লেখা থাকে:
“এখানে প্রতিটি ঘুগনির বাটিতে লুকিয়ে আছে এক-একটা প্রেমের গল্প – একটু ঝাল, একটু মিষ্টি, আর অনেকটা মন।”
কেউ জিজ্ঞেস করলে তৃণা হাসি দিয়ে বলে,
— “প্রেম মানেই একরকম স্বাদ হয় না। তবু একসঙ্গে থাকলে, সেই স্বাদটাই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় হয়ে ওঠে।”
প্রেম কোনো নিখুঁত রেসিপি নয় — কিন্তু যারা ভালোবাসতে জানে, তারা নিজেদের মতো করে তাকে সুস্বাদু করে তোলে। ঝাল হোক, মিষ্টি হোক, একসাথে খেলে তবেই তা প্রেম হয়ে ওঠে।