“ ছোটা বাঘ – এক ডাকাতের আত্মজীবনী”
“ ছোটা বাঘ – এক ডাকাতের আত্মজীবনী” এক হৃদয়স্পর্শী, মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলারধর্মী বাংলা গল্প, যেখানে অন্ধকার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টায় এক ডাকাতের সত্যিকারের মুক্তির লড়াই তুলে ধরা হয়েছে।
অরণ্যের কোলে জন্ম
ভোরের অরণ্য বড় শান্ত। পাখিরা তখনও ডানা ঝাপটায়নি, বাতাসের মাঝে ছড়িয়ে আছে সোঁদা গন্ধ। গা ছমছমে নীরবতা ভেদ করে একটা ছোট্ট ছেলে কুয়াশায় ঢাকা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটছে। তার গায়ে ফাটা জামা, পায়ে স্যান্ডেল নেই। কিন্তু মুখে ভয়ের বদলে একরকম আত্মবিশ্বাস — যেন সে এই অরণ্যকেই চিনে নিয়েছে নিজের মায়ের মতো।
তার নাম কর্ণেল।
জন্ম হয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের এক অখ্যাত গ্রামে — যার নামও খোঁজ করলে মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া কঠিন। আশেপাশে ছিল ঘন জঙ্গল, কাঁটাবন, সোঁদা মাটি আর মাঝে মাঝে হাতি, বাঘের পদচিহ্ন। গ্রামের মানুষজন চাষ করে, কেউ কেউ কাঠ কাটে। কর্নেলের বাবা ছিলেন একজন গাছকাটা কাঠুরে — নাম ছিল জগেন সাহা।
জগেন ছিলেন নীরব, শক্ত মনের মানুষ। যুদ্ধে গিয়েছিলেন একসময়, কিন্তু ফিরে এসে এই অরণ্যের গায়ে বসবাস শুরু করেন। শহরের ভিড়, চাকচিক্য, টানাপোড়েন থেকে দূরে এই নিঃশব্দ জায়গায় পরিবার গড়ে তোলেন। তার স্ত্রী, মাধবী, ছিলেন মিষ্টি স্বভাবের, নরম গলায় গান গাইতেন। কর্নেল ছিল তাদের একমাত্র সন্তান।
কর্ণেল যখন পাঁচ বছরের, তখন এক বর্ষার রাতে মা মারা যান সাপের কামড়ে। গ্রামের ওঝারা কিছুই করতে পারেনি। সেই রাতটা কর্নেলের মনে আজও গেঁথে আছে — এক কাপড় জড়িয়ে সে মায়ের পাশে বসে ছিল, বৃষ্টি ঝরছিল ছাউনির ফাঁক দিয়ে।
এরপর থেকে কর্নেলের জীবন বদলে যায়।
বাবা আর কথা বলতেন না। সকালবেলা কুঠার কাঁধে তুলে নিয়ে অরণ্যে চলে যেতেন, ফিরতেন সন্ধ্যেয়। কর্নেল স্কুলে যায়নি। কেউ পাঠাতে চায়নি। তার লেখাপড়ার সঙ্গী ছিল একটা পুরোনো বই — যা সে কুড়িয়ে পেয়েছিল এক টিনের ট্রাঙ্ক থেকে, যেখানে একটা শহরের মানুষ অনেক বছর আগে ঘুরতে এসে থেকে গিয়েছিল কিছুদিন।
সেই বইটা ছিল এক অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। ডাকাতি, লড়াই, প্রতিশোধ — এসব শব্দ তখনও কর্নেলের মনে ভয় তৈরি করত না, বরং রোমাঞ্চ তৈরি করত। সে তখনই বুঝতে শুরু করেছিল — পৃথিবীটা নিরীহ নয়, আর সবাই সবসময় ভালো হয় না।
জঙ্গলের জীবন তাকে শিখিয়েছিল
- বাঁচতে হলে চুপ থাকতে হয়।
- দূরে শব্দ শুনলে আগে মনোযোগ দিতে হয়, তারপর ছুটতে।
- কাউকে বিশ্বাস করতে হয়, কিন্তু চোখ বুজে নয়।
একদিন বিকেলে, কর্নেল তার বাবার সঙ্গেই জঙ্গলে গিয়েছিল কাঠ কাটতে। হঠাৎই ঝোপের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল তিনজন লোক — মুখ ঢাকা, হাতে বন্দুক। তারা গাছের নীচে বসে টাকা গুনছিল। বাবা টেনে নিয়ে গেল কর্নেলকে চুপচাপ, দূরে একটা শালগাছের আড়ালে। গলা নামিয়ে বলল, “ওরা ডাকাত, বনদস্যু। কাউকে বলবি না। এদের রাগালে কেউ বাঁচে না।”
কিন্তু সেই দৃশ্য কর্নেলকে ভয় দেখায়নি। বরং, তার চোখ বড় হয়েছিল, বুক কাঁপেনি। সেই রাতে, সে জিজ্ঞেস করেছিল বাবাকে, “তারা কেন টাকা পায়, আর আমরা পাই না?”
বাবা কোনো উত্তর দেয়নি। শুধু বলেছিল, “ও পথে গেলে আর ফিরতি রাস্তা থাকে না।”
এতটা বুঝে নেওয়ার মতো বয়স হয়নি তখন কর্নেলের, কিন্তু এই কথাটাই ছিল ভবিষ্যতের এক ইঙ্গিত।
একেকদিন কর্নেল একা একা জঙ্গলে ঢুকে পড়ত। কখনও পাখির বাসা খুঁজত, কখনও শালপাতা দিয়ে মাথার ছাউনি বানাত। একটা বাঁশের বর্শা বানিয়েছিল নিজে হাতে, ওটাই ছিল তার অস্ত্র। কল্পনায় সে তখন অরণ্যের রক্ষাকর্তা — বাঘ এলে লড়বে, ডাকাত এলে ধাওয়া দেবে।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই কল্পনাগুলো বাস্তবের দিকে হেলতে শুরু করল।
কর্ণেল বুঝতে পারল, যাদের সে একসময় ভয় পেত, তারাই জীবনের সুযোগ নেয় বেশি। বাবা দিন রাত খেটে মরছে, আর একদল লোক শহর থেকে এসে স্রেফ ভয় দেখিয়ে পুরো গ্রামের চাল, ডাল, গরু সব নিয়ে চলে যাচ্ছে। গ্রামের কেউ প্রতিবাদ করে না, কারণ ভয় পায়।
তখন থেকেই কর্নেলের মনে জমতে থাকে একধরনের রাগ — সমাজ, অন্যায়, এবং তার নিজের অসহায়তার ওপর।
এক সন্ধ্যায়, কর্নেল বাড়ি ফিরল না।
জঙ্গলের আরেক দিকে, যেটা ‘কালো টিলা’ নামে পরিচিত — সেখানে সে প্রথম দেখা পেল এক ডাকাত সর্দারের। নাম ছিল ভজু খাঁ। গায়ের রঙ কোঁচকানো, মুখে দাড়ি, চোখে লালসা। কর্নেল নিজেই গিয়ে বলেছিল, “আমি তোমাদের দলে আসতে চাই।”
ভজু প্রথমে হেসেছিল, “তোকে দেখেই বুঝি তুই কী ভয়ানক!”
কিন্তু কর্নেলের চোখে ছিল না কোনো ভয়। সে কাঁধে করে নিজের তৈরি বাঁশের বর্শাটা তুলে দেখিয়েছিল, “আমি শিখব। আপনি শিখিয়ে দিন।”
সেই মুহূর্ত থেকেই কর্নেলের জীবন তার প্রথম মোড় নেয়।
সে ফিরে যায়নি বাড়ি, বাবা খুঁজেছিল একমাস ধরে। শেষে ধরেই নিয়েছিল — হয়তো বাঘে খেয়েছে, অথবা নদীতে পড়ে গেছে।
কিন্তু কর্নেল ছিল জীবিত।
জীবিত, কিন্তু আর কর্নেল ছিল না।
তার নাম দেওয়া হয় — ‘ছোটা বাঘ’, ডাকাত দলের নবীন সদস্য।
প্রথম অস্ত্রধারণ
অরণ্যের গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া ছোট্ট একটি নদীর ধারে ডাকাতদের অস্থায়ী ঘাঁটি। দিনের বেলা ঘুম, রাতের অন্ধকারেই নড়াচড়া। কর্নেল, এখন যাকে সবাই ডাকছে ‘ছোটা বাঘ’, সেখানেই পেয়েছে তার নতুন জীবন। জীবনের প্রথমবার সে দেখল বন্দুক, রিভলবার, ধারালো চাকু আর বিস্ফোরক। এগুলোর কোনোটা গল্পে পড়েছিল, কোনোটা কল্পনাও করতে পারেনি।
ভজু খাঁ ছিল রুক্ষ স্বভাবের, কিন্তু চোখ ছিল শিকারির মতো ধারালো। সে বুঝেছিল, এই ছেলেটার চোখে যে আগুন, তা যদি সঠিক পথে চালনা করা যায়, তাহলে সে হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের সেরা সঙ্গী।
“তুই যদি সত্যি সত্যি দলে থাকতে চাস,” একদিন বলল ভজু খাঁ ছোটা বাঘ , “তাহলে শিখতে হবে অস্ত্র চালানো, মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলা, আর সময়মতো কানে না শোনার অভিনয় করা।”
অস্ত্রধারণের শুরুটা ছিল নিছক শিখন প্রক্রিয়া।
ছোটা বাঘ কে প্রথমে শেখানো হয়, কীভাবে ছুরি ফেলা যায় গাছের গায়ে, কীভাবে দৌড়ে গিয়ে হঠাৎ থেমে যাওয়া যায় শব্দ না করে, কীভাবে পাতা সরিয়ে রাস্তা বানাতে হয় যাতে কেউ বোঝে না। প্রতিটি শিক্ষাই ছিল জীবনের প্রয়োজনে — তুচ্ছ কোনো রোমাঞ্চ নয়, বরং নিখুঁত বেঁচে থাকার কৌশল।
একদিন রাতে, সবাই যখন আগুন ঘিরে বসে তামাক টানছিল, ভজু খাঁ কর্নেলের হাতে একটা পুরোনো রিভলবার দিল। “এটা তোর,” সে বলল।
কর্ণেল (ছোটা বাঘ ) বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল।
“তুই এবার আমাদের লোক, ছেলে। এই অস্ত্র মানে ক্ষমতা, ভয়, আর বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা। ভুল করবি না।”
কর্ণেল (ছোটা বাঘ ) মাথা নেড়ে বলল, “আমি পারব।”
রিভলবারটা সে প্রথমে হাতে তুলে ভয় পেয়েছিল — ওজন তার কাঁধে চেপে বসে। কিন্তু ধীরে ধীরে, প্রতিদিনের অভ্যাসে, কর্নেল আর ভয় পেত না। বরং সে জানত, এই রিভলবারই তার নতুন পরিচয়। এই অস্ত্রই তাকে ‘অপরাধী’ বানাবে — আর সেই পরিচয়েই সে গর্ব করতে শিখেছিল।
প্রথম মিশন
তিন মাসের প্রশিক্ষণের পর, ডাকাত দলের নেতৃত্ব তাকে একটি ছোট্ট অভিযানে নিয়ে যায়।
এক ধনী ব্যবসায়ী মাঝরাতে বনের পাশ দিয়ে শহর ফিরছিল। তার গাড়িতে ছিল নগদ টাকা ও গয়না। পরিকল্পনা ছিল সহজ — গাছ ফেলে রাস্তা বন্ধ করে দেবে, গাড়ি থামলেই হানা দেবে।
সেই রাতে কর্নেল (ছোটা বাঘ ) প্রথমবার মাঠে নামল। তার দায়িত্ব ছিল বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে নজর রাখা, যদি কেউ পালানোর চেষ্টা করে।
গাড়ি থামল, ডাকাতরা হুঙ্কার দিয়ে বেরিয়ে এলো।
চালক পালাতে চাইলে, কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে রিভলবার তাক করল। কিন্তু তার আঙুল কাপছিল। গুলি ছোঁড়ার মতো সাহস হয়নি।
তবু সে পিছু হটেনি। দাঁড়িয়ে রইল — মুখ শক্ত করে।
ভজু খাঁ ঘটনাটা দেখছিল দূর থেকে। পরদিন সকালে সে বলল, “গুলিটা ছোঁড়িসনি, কিন্তু ভয়টা ঠিকমতো দেখিয়েছিস। ওটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
বাঁকে বাঁকে কঠিন শিক্ষা
দিন কেটে যায়, কর্নেল বড় হতে থাকে। দলে তার পরিচিতি বাড়ে।
সে শিখে যায় — ভয় দেখিয়ে আদায় করা, মানুষের চোখে তাকিয়ে মিথ্যে বলা, এবং দরকার পড়লে অস্ত্র চালিয়ে দেওয়া।
কিন্তু ভেতরে কোথাও একটা ঘুণপোকা ছিল।
রাতে একা ঘুমোতে গেলে মাঝে মাঝে মায়ের মুখ মনে পড়ত। বাবার গলা শুনতে পেত স্বপ্নে — “তুই ও পথে গেলি, তো আর ফিরতি রাস্তা নেই।”
কিন্তু সেই ফেরার পথ কোথায়? কে তাকে ডাকছে? কে তাকে ভালোবাসবে আর? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর তখন তার কাছে অস্তিত্বহীন।
একবার এক বুড়ো মানুষকে লুট করার সময় কর্নেল থেমে গিয়েছিল। সে বলেছিল, “বয়স হয়েছে, ওনার কিছু নেই।”
ভজু খাঁ রেগে গিয়েছিল, গালাগালি দিয়েছিল — কিন্তু কর্নেল তখন মুখে কিছু না বললেও বুঝেছিল, এখনও সে পুরোটা পাথর হয়ে যায়নি।
চোরাই নাম, গোপন গর্ব
গ্রামাঞ্চলের লোকজন এখন “ছোটা বাঘ”-এর নাম জানে। তাকে নিয়ে গল্প বলে। কেউ ভাবে সে রক্তচোষা, কেউ ভাবে সে বীর। কিন্তু কর্নেল এসবের কিছুতে পাত্তা দেয় না।
তার পরিচয় এখন অস্ত্র, অরণ্য, আর ভয় — এটাই তার জীবন।
তবে সে নিজেও জানে না, এই ভয়েই একদিন ভয়াবহ পরিণতির সূত্রপাত হবে।
দুঃসাহসিক অভিযান ও রক্তের ছাপ
অরণ্য তখন বর্ষার শেষ প্রান্তে। রাতে বৃষ্টি, দিনে রোদ্দুর, আর মাটির গন্ধে ভরা বাতাস। সেই সময়েই ডাকাত দল ঠিক করল একটি বড় অভিযান চালাবে — এমন একটি অভিযান যা পুরো অঞ্চলে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে।
ভজু খাঁ বলল, “এবার সময় এসেছে ছোটা বাঘকে সত্যিকারের ‘বাঘ’ বানানোর।”
টার্গেট: জেলা শহরের এক ধনী জুয়েলারি ব্যবসায়ী — যার বাড়ি গ্রাম থেকে একটু দূরে, কিন্তু নিরাপত্তাহীন, নির্জন।
উদ্দেশ্য: লুটপাট, ভয় তৈরি, এবং প্রয়োজনে রক্তপাত।
পরিকল্পনার রাত
অভিযানের আগের রাতে কর্নেল ঘুমাতে পারেনি। যদিও সে অনেকবার লুটে গেছে, তবে এবার তাকে মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে—দরজা ভাঙা, ভেতরে ঢোকা এবং সামনে থাকা কাউকে নিরস্ত করা।
তার কোমরে এবার নতুন রিভলবার, একদম চকচকে। ভজু খাঁ নিজে এনেছিল মালদা সীমান্ত থেকে।
ভোররাতে বৃষ্টি থেমে গেলে, পাঁচজনের দল গাড়িতে চড়ে রওনা দেয়। জঙ্গলের রাস্তা পেরিয়ে, নদী পার হয়ে, তারা এসে দাঁড়ায় ব্যবসায়ীর বাড়ির একশো গজ দূরে।
বাড়িটি দুই তলা, সামনে ফুলের বাগান, ভেতরে আলো জ্বলছে। কর্নেলের মনে এক মুহূর্তের জন্য চিন্তা জেগেছিল—“যদি ঘরে বাচ্চা থাকে?”
কিন্তু মুখে কিছু বলল না। কারণ এখন সে একজন যোদ্ধা, কোনো দ্বিধা চলে না।
হানা
ঘড়িতে তখন রাত ১টা।
সবাই প্রস্তুত।
কর্ণেল (ছোটা বাঘ )– জানালার কাঁচ ভেঙে ঢুকে পড়ে ভেতরে। দরজার ছিটকিনি খুলে দেয় দলের বাকিদের জন্য।
আলো নিভিয়ে দেয়। পুরো ঘরে নেমে আসে হিমশীতল অন্ধকার।
ব্যবসায়ীর ঘরে প্রথম হানা দেয় ভজু। কর্নেল ঢোকে দ্বিতীয় ঘরে। হঠাৎই মুখোমুখি হয়ে যায় একজন মানুষের সঙ্গে — যুবক, সম্ভবত ব্যবসায়ীর ছেলে।
সে চিৎকার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু কর্নেল (ছোটা বাঘ ) এগিয়ে গিয়ে রিভলবার তাক করে বলে, “এক শব্দ করবি না!”
কিন্তু যুবকটি বাধা দিল। সে কর্নেলের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একটা হাত তার গলার কাছে এল।
আর তখনই —
“ঠাস!”
কর্ণেলের আঙুল রিভলবারের ট্রিগারে চাপ পড়ল।
একটা গুলির শব্দ, সঙ্গে সঙ্গেই এক পশলা নীরবতা।
যুবকটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
কর্ণেল কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। রক্তের গন্ধ তার নাকে আসছে। প্রথমবার কারও শরীরে রক্ত ঝরিয়েছে সে। চোখদুটো স্থির হয়ে আছে ছেলেটির—যেন প্রশ্ন করছে, “তুই কে?”
ভজু পেছন থেকে এসে বলল, “ভয় পাস না। এটাই জীবন।”
কিন্তু কর্নেলের মনে হচ্ছিল, এটা জীবন নয়, এ এক অদ্ভুত শূন্যতা।
প্রত্যাবর্তন
লুটপাট সফল হয়। গয়না, টাকা, মোবাইল — সব ব্যাগে ভরে চলে আসে দল।
কিন্তু কর্নেল এবার আর আগের মতো হাসতে পারে না। রক্তমাখা হাত সে যতবারই ধোয়, মনে হয় এখনও রক্ত লেগে আছে।
ডাকাত দলের কেউ কিছু বলে না। কারণ তারা জানে, এই প্রথম খুন — আর প্রথম খুনের পরেই একেকজন ডাকাত আসলে ‘ডাকাত’ হয়ে ওঠে।
তবে কর্নেলের ভেতরে শুরু হয় এক মানসিক দ্বন্দ্ব।
সে রাত্তিরে ঘুমোতে গেলেও চোখ বন্ধ করলেই দেখে সেই ছেলেটির চোখ, সেই মুহূর্ত, সেই শব্দ — “ঠাস!”
পুলিশের তদন্ত ও ছায়া পিছুটান
এই ঘটনা সংবাদপত্রে আসে।
“রাত্রিবেলা ডাকাতির সময় এক তরুণ খুন – জুয়েলারি দোকানের মালিক গুরুতর আহত”, এই শিরোনাম ছড়ায় চতুর্দিকে।
পুলিশ তদন্ত শুরু করে, কিন্তু সরাসরি কিছু পায় না।
তবে কর্নেল টের পায়, কেউ যেন তাদের গতিবিধি নজরে রাখছে। মাঝে মাঝে জঙ্গলের পাশ দিয়ে পুলিশের জিপ চলে যায়, কেউ কেউ তাদের আড়াল থেকে দেখছে।
একদিন এক লোকাল থানা থেকে একটি পুলিশ অফিসার আসে – নাম অরিন্দম দে। চোখে চশমা, কিন্তু দৃষ্টিতে সন্দেহ। ছোটা বাঘ – নাম সে জানে না, কিন্তু ঘোরাঘুরি শুরু করে তাদের আশেপাশে।
ভজু খাঁ বলে, “ছায়ার পিছু বুঝলেই দৌড় শুরু করতে হয়।”
কিন্তু কর্নেল দৌড়াতে চায় না।
তার মনে প্রশ্ন জাগে —
এই দৌড় কি আজীবন চলবে?
এই অস্ত্র কি তাকে নিরাপত্তা দেবে, নাকি ধ্বংস করবে?
আর সেই ছেলেটার মৃত্যু — তা কি শুধুই ‘পেশাদারি কাজ’?
এক রক্তের ছাপ, যা আর মুছে না
ভোরবেলা কর্নেল নিজের রিভলবারের খাপ খুলে দেখে।
রিভলবারটা আজও চকচকে, ঠিক যেমন ছিল প্রথমদিন।
কিন্তু তার মনে হয়, এটা এখন আর অস্ত্র নয়, এটা যেন একটা অভিশাপ।
সে জঙ্গলের পাশে গিয়ে বসে। বাতাসে এখনো রাতের ঠান্ডা, কিন্তু তার শরীর ঘামে ভিজে। দূর থেকে কুয়াশার মাঝে একটা হরিণ ছুটে যায় — মুক্ত, স্বাধীন।
আর কর্নেল?
সে এখন বন্দী — নিজের অস্ত্র, অপরাধ আর রক্তের ছাপ-এর ভেতরে।
প্রেম, প্রতারণা ও পলায়ন
গভীর অপরাধের পথে যাত্রা শুরু করলেও কর্নেলের ভেতরটা পুরোপুরি পাথর হয়ে যায়নি। একটা গুলির শব্দ, একটা রক্তাক্ত দৃষ্টি আর একরাশ অনুশোচনার ভার সে বয়ে বেড়াচ্ছিল। আর সেই সময়ই তার জীবনে এল এক অপরিচিত আলো—রূপা।
রূপার সঙ্গে প্রথম দেখা
তখন শীতকাল। ডাকাত দলের সাময়িক ঘাঁটি ছিল বাঁকুড়ার কাছে, এক নির্জন গ্রামের পাশে। তারা ছদ্মবেশে লুকিয়ে ছিল – বাইরে থেকে মনে হয় কিছু দিনমজুর এসেছে গাছ কাটা বা বাঁশের কাজ করতে।
একদিন দুপুরে কর্নেল গিয়েছিল বাজারে। পায়ে ধুলো লেগে, মাথায় টুপি। আর সেখানেই তার চোখে পড়ে এক মেয়েকে—হাতে দুধের হাঁড়ি, কাঁধে শাল, চোখে অভিমান।
মেয়েটি হঠাৎ পিছনে ঘুরে চিৎকার করে, “ওই! ছাতা নিয়ে যাচ্ছো কেন?”
এক মাতাল লোক তার ছাতাটি কাঁধে করে হাঁটছিল। কর্নেল দাঁড়িয়ে দেখছিল।
মেয়েটি ছুটে গিয়ে সেই লোকের কাঁধ থেকে ছাতা কেড়ে নেয়, তারপর ঘুরে এসে দেখে কর্নেল তাকিয়ে আছে।
“কি দেখছো?”— রূপা বলেছিল রাগী কণ্ঠে।
“তোমার সাহস।” — কর্নেল হেসেছিল মৃদু।
সেই মুহূর্তটাই ছিল প্রথম স্পর্শ — দুটি বিপরীত জীবনরেখার মুখোমুখি হওয়া।
ভাঙা জীবনে নরম ছোঁয়া
রূপা ছিল স্থানীয় স্কুলশিক্ষকের মেয়ে। মা ছোটবেলায় মারা গেছেন, বাবার দেখাশোনায় মানুষ। সাহসী, স্পষ্টভাষী, কিন্তু ভেতরে দারুণ কোমল।
কর্ণেল নিজেকে পরিচয় দিয়েছিল “বীরু” নামে — বলেছিল, সে নদীয়া থেকে কাজ খুঁজতে এসেছে।
রূপার সঙ্গে দেখা হতে লাগল প্রায় প্রতিদিন। প্রথমে কথার ঝাঁঝ, পরে হাসি, ধীরে ধীরে চোখে চোখে বোঝাপড়া।
এক বিকেলে, মাঠের ধারে বসে কর্নেল বলেছিল, “তুমি যদি চাও, আমি এখানেই থেকে যেতে পারি।”
রূপা কিছু বলেনি। শুধু বলেছিল, “তুমি কেমন মানুষ, সেটা বুঝতে হলে তোমার অতীত জানতে হবে।”
এই কথাটাই কর্নেলের বুক কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
সে কি বলতে পারবে, সে একজন খুনি? সে কি বলতে পারবে, তার হাতেই কোনো এক মা তার ছেলেকে হারিয়েছেন?
প্রেমের ভিতরে অবিশ্বাসের ছায়া
দিন যায়। কর্নেলের মনে সাহস আসে—সে ভাবে, সে সত্যিই পাল্টে যেতে পারে। হয়তো একদিন সব ছেড়ে দিয়ে রূপার সঙ্গে একটা নতুন জীবন শুরু করবে।
কিন্তু জীবন এত সহজ নয়।
একদিন ভোরে, কর্নেল বাজারের দিকে যাওয়ার সময় দেখতে পায় রূপা কথা বলছে একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে। দূর থেকে কিছু শুনতে না পেলেও তাদের মুখের ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল — রূপা কিছু জানায়।
সেই পুলিশ অফিসারের চেহারা কর্নেল চিনতে পারে—এ সেই অরিন্দম দে।
যে ছায়ার মতো তাদের গতিবিধি অনুসরণ করছে।
কর্ণেলের বুক হিম হয়ে যায়।
সেদিন রাতে সে সিদ্ধান্ত নেয়—রূপা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। হয়তো কর্নেলের চেহারা চিনেছে কেউ, অথবা হয়তো রূপা নিজেই তাকে সন্দেহ করে জানিয়ে দিয়েছে।
সে দৌড়ে যায় তার ঘাঁটিতে।
ভজু খাঁ তখন ঘুমোচ্ছিল। কর্নেল চুপচাপ তার রিভলবারটা ব্যাগে ভরে নেয়, সঙ্গে কিছু টাকা, আর একটা ছেঁড়া চিঠি — যেখানে সে রূপাকে লিখেছিল তার সব কথা জানিয়ে দেবে একদিন।
পলায়ন
মধ্যরাতে কর্নেল চুপচাপ ঘাঁটি ছাড়ে। অরণ্যের পথ ধরে ছুটতে থাকে একা, পেছনে ফেলে তার পরিচয়, অস্ত্র, দলে থাকা প্রতিটি সম্পর্ক।
সে যায় না রূপার কাছে।
সে চায় না তার ভালোবাসা হয়ে থাকুক রক্তমাখা।
সে চায় না রূপা কখনো জানুক — যে ছেলেটাকে সে ভালোবেসেছিল, সে আসলে এক অপরাধী।
কর্ণেল ছুটতে থাকে — দিনের পর দিন।
শহর বদলায়, নাম বদলায়। এক সময় পৌঁছায় কলকাতায়, এক পুরনো ঘিঞ্জি এলাকায়।
সেখানে সে পরিচয় দেয়—“আমি একজন কাঠমিস্ত্রি। আমি নাম পাল্টেছি, জীবন পাল্টেছি।”
একাকীতার রাত
কিন্তু পালানো মানেই মুক্তি নয়।
রাত্রে একা বিছানায় শুয়ে, কর্নেলের চোখে ভেসে ওঠে রূপার মুখ।
সে ভাবে, যদি সে রূপার চোখে সত্যি নিজেকে তুলে ধরত, তবে কী হতো?
রূপা কি তাকে গ্রহণ করত?

কিন্তু আর ফিরতি পথ নেই।
কারণ পলায়ন শুধু শরীরের নয়, আত্মারও।
“রূপা,
তুমি যদি কোনোদিন এই চিঠিটা পাও, জেনে রেখো—আমি তোমাকে ভালোবাসতাম।
আমার অতীত পাপময়, কিন্তু আমার ভালবাসা ছিল নিখাদ।
আমি কখনোই চাইনি তুমি একজন খুনিকে ভালোবাসো।
তাই চলে গিয়েছিলাম, তোমাকে রক্ষা করার জন্য।
তুমি ভালো থেকো।
– কর্নেল (ছোটা বাঘ)”
মুক্তি ও আত্মজবানবন্দি
কলকাতার বুকে এক পুরনো অলিগলির ভেতরে ছোট্ট এক বৃদ্ধাশ্রম—“শান্তিনিবাস”। এখানে কেউ কষ্টের ভারে, কেউ নিঃসঙ্গতায়, কেউ বা নিঃশব্দ মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন কাটায়। সেখানেই, এক কোনার ঘরে বসে এক বৃদ্ধ চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর চোখে কাঁচের চশমা, গালে চাপা দাড়ি, কপালে ভাঁজ, আর ভিতরটা গভীর কষ্টে জমাট।
এই বৃদ্ধই কর্নেল সাহা—ডাকাত দলের প্রাক্তন সদস্য, যাকে একসময় গোটা জঙ্গল-অঞ্চল চিনত “ছোটা বাঘ” নামে।
শেষ অধ্যায়ের শুরু
বয়স এখন প্রায় ৬৭। হাঁটুর ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, হালকা স্মৃতিভ্রংশ—তবু মনটা সজাগ।
শেষ জীবনে, কর্নেল আর পালাতে চায় না।
পলায়নের পর প্রায় ৩০ বছর কেটে গেছে—এই বিশাল সময় সে কাটিয়েছে নানান ছদ্মবেশে, কাঠমিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কখনও পোর্টার, কখনও ওয়াচম্যান।
কিন্তু প্রতিদিন রাতের ঘুম ভেঙেছে একটা চিত্রে—একটা গুলির শব্দ, এক জোড়া রক্তাক্ত চোখ, আর একটি চিঠি যা কোনোদিন পাঠানো হয়নি।
নিজেকে ক্ষমা করার লড়াই
বৃদ্ধাশ্রমে এসেছেন স্বেচ্ছায়। কোনো পরিবার নেই, কোনো উত্তরাধিকারীও না। একদিন নিজের সামান্য সঞ্চয় দিয়ে ভর্তি হন এখানে। কর্তৃপক্ষ জানত না তাঁর অতীত, শুধুই জানত—এই বৃদ্ধ একা, নির্জন, এবং ভীষণ চুপচাপ।
কিন্তু কর্নেল জানত, সময় এসেছে নিজের কাহিনি বলার।
সে নিজের অপরাধ স্বীকার করতে চায়, নিজের গৃহপালিত ছায়াকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায়।
এক লেখকের আবির্ভাব
একদিন বৃদ্ধাশ্রমে এল এক তরুণ লেখক—সায়ন ব্যানার্জি, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্য, যারা প্রবীণদের গল্প নিয়ে বই লেখে।
সে কর্নেলের ঘরে গিয়ে বলেছিল,
“দাদু, আপনি কী বলেন, আপনাকে নিয়ে একটা গল্প লেখা যায়?”
কর্ণেল প্রথমে চুপ ছিল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“তুই লিখবি? তবে সত্যিটাই লিখিস। আমি খুনি, ডাকাত। আমি ভালো মানুষ ছিলাম না।”
সায়নের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গিয়েছিল।
সে ভাবেনি এমন একটা নিরীহ বৃদ্ধের ভিতরে এমন জ্বলন্ত অতীত লুকিয়ে আছে।
জবানবন্দির দিনগুলি
পরবর্তী কয়েক মাস ধরে কর্নেল প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে তার জীবন গল্প বলতে লাগল—ছেলেবেলা, মা-বাবা, জঙ্গল, প্রথম অস্ত্রধারণ, রক্তপাত, রূপার সঙ্গে প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, এবং পলায়ন।
কর্ণেল বারবার বলত,
“আমি মুক্তি চাই। আমি বিচার চাই। তবে আদালতের নয়, নিজের বিবেকের।”
সায়ন তার প্রতিটি কথা রেকর্ড করত, লিপিবদ্ধ করত। একসময় কর্নেল বলেছিল,
“এই গল্প ছাপা হলে, রূপা যদি কোথাও থাকে, হয়তো একদিন জেনে যাবে আমি তাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম ভালোবেসে, না ঘৃণা করে নয়।”
একটি চিঠি, যা কখনো পাঠানো হয়নি
এক রাতে কর্নেল সায়নের হাতে তুলে দেয় একটি পুরনো খাম।
সেখানে ছিল সেই চিঠি—রূপার উদ্দেশে লেখা।
সায়ন পড়ে কেঁদে ফেলেছিল।
সে জিজ্ঞেস করেছিল,
“আপনি কি চান, আমি রূপাকে খুঁজে চিঠিটা দিয়ে দিই?”
কর্ণেল বলেছিল,
“না। এটা আমার লেখা শেষ পাতার মতো। পাঠানো হয়নি, আর পাঠানোর প্রয়োজনও নেই। যদি কখনো সে এই বই পড়ে, ও নিজেই বুঝে যাবে—আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম। সত্যি ভালোবেসেছিলাম।”
অন্তিম মুহূর্ত
এক ভোরবেলা, কর্নেল ঘুম থেকে উঠে চুপচাপ জানালার পাশে বসেছিল।
সায়ন এসে বলেছিল, “বইটার নাম কী রাখি?”
কর্ণেল বলেছিল,
“শেষ ডাকাতি: এক অরণ্যপুরুষের জবানবন্দি।”
সেই ছিল কর্নেলের মুখ থেকে শেষ কথা।
সেই দুপুরেই, নিঃশব্দে, কর্নেল চলে গেল।
কোনো কষ্ট নেই, আর কোনো পলায়ন নেই,
শুধু এক দীর্ঘশ্বাস, আর এক বুক ভারমুক্তি।
এই গল্প কোনো রূপকথা নয়।
এটা এক বাস্তব জীবনের খণ্ডচিত্র, যেখানে অপরাধের মধ্যেও থাকে ভালোবাসা, এবং ঘৃণার মধ্যেও থাকে অনুশোচনা।
একজন ডাকাতও, যদি চায়, নিজেকে বদলাতে পারে। যদি সমাজ তার গল্পটা শোনে।
এই গল্প কেবল কর্নেলের নয় — এই গল্প সমাজের, ভালোবাসার, ভুলের, এবং সংশোধনের।