শেষ ফাইল

“শেষ ফাইল”

অন্ধকার ফোনকল

রাত তখন সাড়ে এগারোটা। কলকাতার আকাশে একটানা বৃষ্টি ঝরছে, রাস্তার বাতিগুলো ভিজে কুয়াশায় কাঁপছে।
পার্ক স্ট্রিট থানার ভেতরে সবাই ধীরে ধীরে কাজ গুটিয়ে নিচ্ছে। কেবল ইন্সপেক্টর অনিরুদ্ধ সেন তখনও নিজের ডেস্কে বসে, পুরোনো ফাইলের ধুলো ঝাড়ছেন।

হঠাৎই টেবিলের কোণে রাখা পুরোনো ল্যান্ডলাইনের রিং বেজে উঠল—
একটা কর্কশ, অস্থির শব্দ, যা রাতের নীরবতাকে কেটে ফেলল।
তিনি রিসিভার কানে তুলতেই ওপাশে নিস্তব্ধতা… কেবল দূরে বৃষ্টির শব্দ আর হালকা এক নিঃশ্বাস।

তারপরই শোনা গেল এক অচেনা, ঠান্ডা কণ্ঠ—
“ইন্সপেক্টর সেন… আপনি যদি আপনার জীবনকে ভালোবাসেন, তাহলে সেই ফাইল থেকে দূরে থাকুন।”

অনিরুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বললেন, “কে কথা বলছেন? কোন ফাইলের কথা বলছেন?”
ওপাশ থেকে ক্ষীণ হাসি শোনা গেল, যেন কেউ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে—
“আপনি জানেন… বালিগঞ্জ ম্যানশন।”

তারপর লাইন কেটে গেল।
রিসিভার হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন অনিরুদ্ধ।
“বালিগঞ্জ ম্যানশন”—এই নাম তার কাছে অপরিচিত নয়।
তিন বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই হত্যাকাণ্ড, যা কখনোই সমাধান হয়নি।

বাইরে বজ্রপাত হল, জানলার কাঁচ কেঁপে উঠল।
অনিরুদ্ধ অনুভব করলেন—এই ফোনকল শুধু হুমকি নয়, বরং একটি খেলা শুরু হয়েছে, আর খেলায় তাকে নেমেই হবে।

পুরোনো কেসের ধুলো

পরদিন সকাল। থানার আর্কাইভ রুমের দরজা খুলতেই ভেতর থেকে ধুলোর গন্ধে নাকে ঝাঁঝ লাগল।
পুরোনো লোহার আলমারিতে সারি সারি ফাইল সাজানো—
কিছু ফাইলের কাগজ হলদে হয়ে গেছে, কিছুতে ইঁদুরের কামড়ের দাগ।

অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে খুঁজে বের করলেন সেই ফাইল—
লাল কাপড়ে মোড়া, উপরে বড় অক্ষরে লেখা—“বালিগঞ্জ ম্যানশন হত্যা মামলা”
আঙুলের ডগা দিয়ে ধুলো ঝেড়ে ফাইল খুলতেই প্রথম পাতায় ভেসে উঠল মেয়েটির ছবি—
সোনালী চুলের মতো রঙের লম্বা চুল, হাসিমুখ, চোখে যেন অজস্র স্বপ্ন।
নাম—ঋতিকা সেনগুপ্ত

ফাইলের রিপোর্টে লেখা—
তিন বছর আগে, বালিগঞ্জের এক প্রাচীন ম্যানশনে ২৩ বছর বয়সী ঋতিকার মৃতদেহ পাওয়া যায় বেসমেন্টে।
হত্যার সময় রাত আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে।
ময়নাতদন্তে দেখা যায়, গলায় চাপ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছে।
তখনকার তদন্তে কয়েকজন সন্দেহভাজন ছিল—

  1. রবি চৌধুরী—ঋতিকার প্রাক্তন প্রেমিক।
  2. কেয়ারটেকার নরেন দত্ত—যিনি ঘটনার রাতে নিখোঁজ ছিলেন।
  3. অজানা এক পুরুষ—যাকে ম্যানশনের আশেপাশে একবার দেখা গিয়েছিল, কিন্তু পরে আর পাওয়া যায়নি।

তদন্ত শেষ পর্যন্ত স্থগিত হয়, কারণ প্রত্যেকের অ্যালিবাই শক্ত ছিল, আর প্রমাণ ছিল না।
কিন্তু আজ, তিন বছর পর, হঠাৎ এই ফাইল নিয়ে হুমকি কেন?

অনিরুদ্ধ ফাইলের পাতা উল্টে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ একটি পাতায় কিছু দাগ দেখতে পেলেন—
কালো কালিতে আঁকা অদ্ভুত একটি চিহ্ন, যা অফিসিয়াল রিপোর্টে থাকার কথা নয়।
এটি দেখতে অনেকটা পাখির নখের মতো, কিন্তু প্রমাণ হিসেবে কেন এখানে রাখা হয়েছে, তা কেউ উল্লেখ করেনি।

তিনি নিজের নোটবুকে লিখে রাখলেন—
“চিহ্নটি খুঁজে বের করো। এটাই সূত্র।”

বাইরে তখন রোদের ফাঁকে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে।
অনিরুদ্ধ জানতেন, এই ফাইলের ধুলো ঝাড়তে গিয়েই হয়তো তিনি এমন এক দরজা খুলে ফেলেছেন, যা বন্ধ থাকাই ভালো ছিল…

লুকানো প্রমাণ

সন্ধ্যা নামতেই আকাশে কালো মেঘ জমেছে। থানার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অনিরুদ্ধ চুপচাপ সিগারেট টানছিলেন।
তার মাথায় ঘুরছে সেই কালো চিহ্ন—পাখির নখের মতো আঁচড়—যেটা “বালিগঞ্জ ম্যানশন” ফাইলের পাতায় পাওয়া গেছে।
রাতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ম্যানশনে গিয়ে কেয়ারটেকারের সঙ্গে দেখা করবেন।

ম্যানশনটি এখন প্রায় পরিত্যক্ত, চারপাশে বুনো ঘাস আর ধ্বংসপ্রায় দেওয়াল।
কেয়ারটেকার নরেন দত্ত দরজায় এলেন, চোখে সন্দেহের দৃষ্টি।
“তিন বছর হয়ে গেছে, স্যার… ওই দিনের কথা আর তুলবেন না,” গলা কেঁপে গেল তার।

অনিরুদ্ধ সোজা প্রশ্ন করলেন, “ঋতিকার ঘরের জিনিসপত্র কি সব পুলিশের হাতে গেছে?”
নরেন একটু দ্বিধা করে বললেন, “সব না স্যার… একটা ডায়েরি ছিল, যেটা আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম।”
তিনি পকেট থেকে ছোট্ট, চামড়ায় বাঁধানো একটা ডায়েরি বের করলেন।

ডায়েরির প্রথম কয়েকটি পাতা সাধারণ—বন্ধুদের নাম, আঁকিবুঁকি, আর কবিতার লাইন।
কিন্তু মাঝখানের পাতায় কেবল অদ্ভুত কিছু কোড লেখা—সংখ্যা আর অক্ষরের মিশ্রণ, যা কোন ভাষার সাথে মেলে না।
প্রতিটি পাতার কোণে সেই একই কালো পাখির নখের মতো চিহ্ন।

ডায়েরির শেষ পাতায় শুধু একটি বাক্য—
“যদি আমি হারিয়ে যাই, সন্ধ্যা নামার আগে পুরোনো ঘড়িঘরের কাছে দেখা করো।”

অনিরুদ্ধ বুঝলেন, এই কোড আর চিহ্নই সত্যের চাবি।
কিন্তু ঘড়িঘরের কথা শোনামাত্র নরেনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল—
“স্যার, ওই ঘড়িঘর… অনেক বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। আর ওখানে…”
সে কথা শেষ করার আগেই বাইরে বজ্রপাত হল, আর হঠাৎ কোথাও দূরে কাকের ডাকে রাতের নিস্তব্ধতা কেঁপে উঠল।

রাতের শিকারি

কলকাতার রাত তখন প্রায় নিস্তব্ধ।
দূরের ট্রামের ঘণ্টা যেন কোথাও খুব ধীরে বাজছে।
অনিরুদ্ধ একাই যাচ্ছেন শহরের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পুরোনো ঘড়িঘরের দিকে—
যেটা বহু বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে, আর এখন কেবল ভাঙা কাঁচ আর মরচে ধরা লোহার সিঁড়ি বেয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতীতের মতো।

chatgpt image aug 11, 2025, 05 28 33 am

ডায়েরির শেষ পাতার ইঙ্গিত অনুযায়ী, আজ রাতেই তিনি এখানে আসবেন।
পকেটে রাখা টর্চ আর সার্ভিস রিভলভার—তার একমাত্র সঙ্গী।

ঘড়িঘরের ভেতরে ঢুকতেই একটা ঠান্ডা হাওয়া কানের পাশে ফিসফিস করে বয়ে গেল।
পায়ের নিচের কাঠের ফ্লোরে চাপ পড়তেই ‘ক্র্যাক’ শব্দ হলো, যা অন্ধকারে অস্বস্তিকরভাবে প্রতিধ্বনিত হল।
টর্চের আলো দেওয়ালে পড়তেই দেখা গেল—পুরনো পোস্টার, খসে পড়া প্লাস্টার, আর মাঝেমধ্যে অস্পষ্ট কিছু আঁচড়ের দাগ…
যেন কেউ এখানে অদ্ভুত চিহ্ন এঁকেছে।

হঠাৎ উপরতলার সিঁড়ি থেকে শোনা গেল ধীর পায়ের শব্দ—
টিক… টিক… টিক…
মনে হলো কেউ ইচ্ছে করেই ধীরে হাঁটছে, যাতে শব্দ শোনা যায়।

অনিরুদ্ধ রিভলভার হাতে নিয়ে ডাকলেন—
“কে ওখানে? বেরিয়ে আসো!”

উত্তর এল না।
বরং হঠাৎ শব্দ থেমে গেল।

ঠিক সেই মুহূর্তে, পিছন দিক থেকে একটা ছায়া ঝাঁপিয়ে পড়ল!
অনিরুদ্ধ পড়ে গেলেন মেঝেতে, রিভলভার গড়িয়ে দূরে চলে গেল।
দুইজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হলো—ছায়াটির হাতে ছিল ধারালো ছুরি, যা বারবার অনিরুদ্ধের গলা লক্ষ্য করে আসছিল।
কিন্তু টর্চের আলোয় এক মুহূর্তের জন্য তার মুখ ধরা পড়ল—
কালো মুখোশে ঢাকা, কেবল চোখ দেখা যাচ্ছে—কিন্তু সেই চোখে এক শীতল নিষ্ঠুরতা।

যত তাড়াতাড়ি সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তত দ্রুতই সরে গেল অন্ধকারের দিকে।
দৌড়ে পালানোর আগে তার পকেট থেকে কিছু একটা মেঝেতে পড়ে গেল—
অনিরুদ্ধ সেটা হাতে নিতেই দেখলেন—
একটি কালো চামড়ার দস্তানা, যার ভেতরের সেলাইয়ের মধ্যে লুকানো আছে ছোট্ট একটি মেমোরি চিপ।

বাইরে তখন বাতাসে কাকের ডাক মিলিয়ে যাচ্ছিল, আর ঘড়িঘরের পুরোনো ঘণ্টা হঠাৎ নিজে থেকেই একটা শব্দ করে উঠল—
যেন শহরকে জানিয়ে দিচ্ছে, খেলার আসল শুরু এখন…

আসল মুখোশ

ভোর ৩টা। থানার কম্পিউটার রুমে একমাত্র আলো জ্বলছে।
অনিরুদ্ধ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বসে আছেন, আর ফরেনসিক টিম মেমোরি চিপের ডেটা ডিক্রিপ্ট করছে।
মনিটরের পর্দায় ধীরে ধীরে ভেসে উঠতে শুরু করল অসংখ্য ছবি—
বালিগঞ্জ ম্যানশনের অন্ধকার বেসমেন্ট, রক্তমাখা মেঝে, আর… ঋতিকার নিথর দেহ।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
আরও কিছু ভিডিও ফাইল আছে—
একটিতে দেখা গেল ঋতিকা বেঁচে আছে, ভয় পেয়ে কাঁদছে, আর পিছনে এক পুরুষের ছায়া ঘনিয়ে আসছে।
মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু গলায় একটা অদ্ভুত তাবিজ ঝুলছে—
কালো পাথরের মধ্যে রূপার পাখির নখ বসানো।

অনিরুদ্ধের মনে হঠাৎ এক ঝলক এলো—এই তাবিজ তিনি আগে দেখেছেন!
হ্যাঁ… তিন বছর আগে কেসের সময়, ঋতিকার মামা অশোক সেনগুপ্ত এই তাবিজ পরতেন।
তখন তিনি বলেছিলেন, এটি পারিবারিক ঐতিহ্য।

অশোক এখন শহরের বাইরে একটি ফার্মহাউসে থাকেন।
কোনো বিলম্ব না করে, অনিরুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে স্পেশাল টিম নিয়ে ফার্মহাউসে পৌঁছে গেলেন।

ফার্মহাউসের ভেতর নীরবতা—
কেবল বাইরে কুকুরের ডাক আর দূরে বজ্রপাতের শব্দ।
ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল, দেওয়ালে সেই কালো পাখির নখের চিহ্ন খোদাই করা।
এবার সন্দেহের আর অবকাশ নেই।

হঠাৎ পিছনের ঘর থেকে গুলির শব্দ—
টিমের একজন চিৎকার করে উঠল, “স্যার! উনি পালাচ্ছেন!”

পিছনের দরজা দিয়ে অশোক ছুটে বেরিয়েছেন, হাতে পিস্তল।
বৃষ্টিভেজা মাঠের ভেতর তাড়া শুরু হলো।
একসময় অনিরুদ্ধ চিৎকার করলেন—
“অশোক! থামো! পালিয়ে বাঁচতে পারবে না!”

অশোক এক মুহূর্ত থেমে পিছনে তাকালেন—চোখে পাগলামির ঝিলিক।
“তুমি জানো না, সেন… এটা শুধু একটা হত্যা নয়। এটা ছিল উত্তরাধিকার বাঁচানোর যুদ্ধ!”

কথা শেষ হতেই অশোক গুলি চালালেন, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো।
অনিরুদ্ধ সুযোগ নিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিলেন, আর হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিলেন।

থানায় ফেরার সময় অশোকের মুখোশ সবার সামনে খুলে গেল—
প্রকাশ পেল, তিনি ঋতিকাকে হত্যা করেছিলেন, যাতে তার ব্যবসা ও সম্পত্তি পুরোপুরি নিজের হাতে আসে।
তিন বছর ধরে তিনি প্রমাণ লুকিয়ে রেখেছিলেন, আর সাক্ষীদের ভয় দেখিয়েছিলেন।

ফার্মহাউসের ভেতর আরও চাঞ্চল্যকর প্রমাণ মিলল—ঋতিকার ডায়েরির বাকি পাতাগুলো, আর কালো পাখির নখের একগুচ্ছ প্রতীক।

সেই রাতেই থানায় “বালিগঞ্জ ম্যানশন হত্যা মামলা” ফাইলের শেষ পাতায় বড় অক্ষরে লেখা হলো—
CASE CLOSED

তবে অনিরুদ্ধ জানতেন, শহরের অন্ধকারে আরও অনেক মুখোশ লুকিয়ে আছে, যাদের আসল চেহারা বের করতে হবে…
আর খেলা শেষ হয়নি।

প্রিয় পাঠক,
“শেষ ফাইল” গল্পটি শুধু কাগজের পাতায় আটকে থাকা একটি ঘটনা নয়, এটি মানুষের জীবনের শেষ মুহূর্তের লড়াই, অসমাপ্ত ইচ্ছা আর অপ্রকাশিত আবেগের গল্প। গল্পকথায় আমরা চেষ্টা করি আপনাদের কাছে এমন সব কাহিনী পৌঁছে দিতে, যা হৃদয়ে দাগ কাটে, মনে প্রশ্ন তোলে এবং ভাবতে শেখায়।
আপনাদের ভালোবাসা, মন্তব্য আর শেয়ার আমাদের নতুন গল্প লেখার প্রেরণা জোগায়। তাই পড়ে যদি ভালো লাগে, বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না, আর আপনার মতামত জানিয়ে আমাদের সঙ্গেই থাকুন। ❤️

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *