“শুধু তুমি থেকো পাশে”….
চতুর্থ পর্ব
সমাজের বাঁধন
“যখন সব দিক থেকে বাঁধন আসবে, তখন শুধু তুমি থেকো পাশে…”
গ্রামের আকাশে তখন পূর্ণিমার আলো। চারপাশে সাদা-নীল আভা, নদীর বুকে রুপোলি ঝিলিক। মায়া আর অয়ন নদীর ধারে বসেছিল, নীরবে। দূরে ঢোল-বাদ্যের আওয়াজ ভেসে আসছিল—গ্রামে পূজোর আয়োজন চলছে।
কিন্তু মায়ার চোখে যেন অদৃশ্য অন্ধকার।
কানাঘুষো
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গ্রামের অলিগলিতে, চায়ের দোকানে, এমনকি স্কুলের করিডোরে মায়া আর অয়নকে নিয়ে নানা কথা ভাসতে শুরু করেছে।
“ওরা শুধু বন্ধু নয়।”
“মেয়েটা শহুরে ছেলেটার ফাঁদে পড়েছে।”
“গ্রামের সম্মান নষ্ট করবে।”
মায়া যেখানেই যায়, কটুকথার তীর তাকে বিদ্ধ করে। একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় পাশের বাড়ির মধুমিতা কাকি ঠাট্টার সুরে বললেন—
“বেশ আছো যে, শহরের ছেলেকে ফাঁদে ফেলেছো বুঝি?”
মায়া লজ্জায় মাথা নিচু করে হেঁটে গেল।
অন্যদিকে অয়নও চাপ অনুভব করছিল। চায়ের দোকানে বসলে একদল ছেলে আড়চোখে তাকাত, কেউ আবার ফিসফিস করে হাসাহাসি করত। অয়ন মুখে কিছু না বললেও ভেতরে আগুন জ্বলত।
পরিবারে ঝড়
এক সন্ধ্যায় মায়ার দাদা হঠাৎ রাগে গর্জে উঠল।
“শুনেছি তুই আবার শহরের ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিস? আমাদের মুখ রাখতে হবে সমাজে, এসব চলবে না।”
মা চোখ মুছে বললেন—
“মেয়েদের জন্য এভাবে নাম খারাপ হয় না। তুই কি বুঝিস না, মানুষের জিহ্বা কত ধারালো?”
মায়া কেঁদে ফেলল—
“দাদা, আমরা শুধু বন্ধু। ও আমার গানকে বিশ্বাস করে, আমায় স্বপ্ন দেখতে শেখায়।”
কিন্তু দাদার রাগ কমল না।
“গান-টান বাদ দে। সংসারে মেয়েদের গান দিয়ে পেট চলে না।”
মায়া তখন মনের ভেতর এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব অনুভব করল। একদিকে অয়ন, যে তাকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে; আরেকদিকে পরিবার, যারা সমাজের ভয়ে তাকে বেঁধে রাখতে চাইছে।
অয়নের সংকল্প
অয়ন মায়ার চোখের জল দেখল। এক সন্ধ্যায় সে বলল—
“মায়া, ভয় পেও না। আমি আছি। সমাজ যতই কথা বলুক, তোমার স্বপ্নকে আমি ভাঙতে দেব না।”
মায়া কাঁপা গলায় বলল—
“কিন্তু অয়ন, দাদা, মা যদি আমায় গান গাইতে না দেয়? যদি ওরা আমার ডানা কেটে দেয়?”
অয়ন তার হাত চেপে ধরল—
“ডানা কেউ কেটে দিতে পারে না, যদি তুমি নিজেই উড়তে চাও। আমি তোমার পাশে আছি, এই সমাজের বাঁধন আমরা একসাথে ভাঙব।”
মায়ার চোখে সেই মুহূর্তে অদ্ভুত এক শক্তি জেগে উঠল।
দাদার কঠোরতা
সেদিনের ঘটনার পর মায়ার দাদা আরও কড়া হয়ে উঠল।
রাতে খাওয়ার টেবিলে সে গম্ভীর গলায় বলল—
“মা, তুমি মেয়েকে বুঝাও। এখন থেকে ওর চলাফেরায় কড়া নজর দিতে হবে। যেদিকে-সেদিকে যাবে না। বিশেষ করে ওই শহুরে ছেলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকবে না।”
মা মাথা নিচু করে চুপ করে রইলেন। তিনি জানেন মেয়ের মনটা ভীষণ ভঙ্গুর, কিন্তু দাদার কথার সামনে প্রতিবাদ করার সাহস নেই।
মায়া শুধু নীরবে চোখের জল সামলাল।
গ্রামের মানুষের চোখে
পরের দিন সকালে মায়া স্কুলে যাওয়ার পথে বাজারের একপাশে দাঁড়ানো কিছু মানুষ তাকে দেখে ফিসফিস শুরু করল।
“ওই যে মেয়েটা, শহরের ছেলেকে ফাঁসাচ্ছে।”
“ওর বাপ নেই, তাই না? তাই হবে।”
শব্দগুলো মায়ার বুকের ভেতর ছুরির মতো বিঁধল। সে দ্রুত হাঁটল, যেন কিছু শুনছে না।
কিন্তু মনে মনে ভাবল—
মানুষ কেন শুধু কটুকথাই বলে? কেন তারা আমার স্বপ্ন দেখতে পারে না?
অয়নের অভিমান
অয়নও বিষয়টা টের পাচ্ছিল। কয়েকদিন ধরে মায়া তার সঙ্গে কম কথা বলছে, এড়িয়ে যাচ্ছে।
এক সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে অয়ন অপেক্ষা করছিল। অবশেষে মায়া এল, মুখে ক্লান্তি আর চোখে লুকোনো অশ্রু।
অয়ন ধীরে জিজ্ঞেস করল—
“তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ কেন, মায়া? আমি কি কোনো ভুল করেছি?”
মায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল—
“না অয়ন, তোমার কোনো দোষ নেই। কিন্তু দাদা আর গ্রামের মানুষ আমাকে শ্বাস নিতে দিচ্ছে না। তারা বলছে তোমার সঙ্গে দেখা করা যাবে না। আমি… আমি ভয় পাচ্ছি।”
অয়ন কষ্ট পেয়ে বলল—
“তাহলে কি সমাজের ভয়েই তুমি আমাদের স্বপ্ন ছেড়ে দেবে?”
মায়া চোখ নামিয়ে নিল। উত্তর দিতে পারল না।
অয়নের অঙ্গীকার
অয়ন কিছুক্ষণ নীরব থেকে দৃঢ় কণ্ঠে বলল—
“মায়া, আমি জানি পথটা কঠিন। সমাজ বাঁধা দেবে, মানুষ কটুকথা বলবে। কিন্তু যদি আমরা নিজেদের বিশ্বাস করি, কেউ আমাদের থামাতে পারবে না। আমি চাই তুমি লড়াই করো—নিজের জন্য, তোমার গানের জন্য।”
মায়া চোখে জল নিয়ে তাকাল। অয়নের দৃঢ়তায় সে ভরসা পেল, কিন্তু ভয়ও কমল না।
তার মনের মধ্যে তখন শুধু এক প্রশ্ন ঘুরছিল—
আমি কি পারব সমাজের বাঁধন ভেঙে সামনে এগোতে?
এক সন্ধ্যায় বাড়ির উঠোনে চুপচাপ বসেছিল মায়া। হঠাৎ দাদা গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকল।
সে মা-কে ডেকে বলল—
“শুনে রাখো, মায়াকে আর বাইরে যেতে দেওয়া হবে না। স্কুল শেষ হলেই ঘরে ফিরতে হবে। আর ওই শহুরে ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে ভালো হবে না।”
মায়ের মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি আস্তে বললেন—
“কিন্তু বাবু, মেয়ে তো শুধু গান ভালোবাসে। ওই ছেলেটা তাকে সাহস দেয়।”
দাদা গর্জে উঠল—
“গান দিয়ে সংসার চলে না, মা! আজকাল সমাজে যে সব কথা উঠছে, আমি সহ্য করতে পারছি না। এখনই একটা বিয়ের কথাবার্তা ভাবতে হবে। তবেই সব শান্ত হবে।”
মায়ার শরীরটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। বিয়ে? এত তাড়াতাড়ি?
তার চোখ ভরে উঠল অশ্রুতে।
রাতেই মায়া গোপনে নদীর ঘাটে গিয়ে অয়নকে সব জানাল।
কাঁপা গলায় বলল—
“দাদা আমাকে বন্দি করে রাখবে। আর শীঘ্রই আমার বিয়ে দিতে চায়।”
অয়নের চোখে রাগ আর দুঃখ একসঙ্গে জ্বলল।
“এ কেমন অবিচার? তোমার স্বপ্ন, তোমার জীবন—সব সমাজের ভয়ে নষ্ট করে দেবে ওরা? মায়া, তুমি কি চাও আমি চুপ করে থাকি?”

মায়া ফুঁপিয়ে উঠল—
“আমি চাই না তুমি কোনো ঝুঁকি নাও। শুধু চাই… তুমি থেকো পাশে। আমার শক্তি হয়ে থেকো।”
অয়ন তার হাত ধরে দৃঢ় কণ্ঠে বলল—
“তুমি ভয় পেয়ো না। সমাজের বাঁধন যতই শক্ত হোক, আমি তোমার হাত ছাড়ব না।”
সেদিন রাতে মায়া শুয়ে শুয়ে ভাবছিল—
একদিকে দাদার কঠোরতা, সমাজের বাঁধন, আর অন্যদিকে অয়নের ভালোবাসা আর তার গানের স্বপ্ন।
আমি কি দাদার কথা মেনে নিয়ে বিয়ের অন্ধকারে হারিয়ে যাব? নাকি নিজের ভেতরের শক্তি খুঁজে বের করে দাঁড়াব?
চোখের জল বালিশ ভিজিয়ে দিল, কিন্তু মনে মনে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা জন্ম নিল।
পরদিন ভোরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল মায়া।
সূর্য উঠছে ধীরে ধীরে। মায়া মনে মনে বলল—
“যা-ই হোক না কেন, আমি আমার স্বপ্ন ছাড়ব না। গানই আমার প্রাণ, আর অয়নই আমার সাহস।”
তার চোখে তখন সমাজের বাঁধনের ভয় নয়, বরং একরাশ অদম্য আলো।
অয়নের হাত আঁকড়ে ধরে স্বপ্ন দেখল মায়া, অথচ ভাগ্য তাকে ঠেলে দিতে চলেছে প্রতিকূলতার আগুনে।
👉 কি ঘটতে চলেছে? জানতে হলে পড়ুন পঞ্চম পর্ব—
🔥 “প্রতিকূলতার আগুন”