শুধু তুমি থেকো পাশে....
|

“শুধু তুমি থেকো পাশে”

প্রথম পর্ব:

প্রথম দেখা…

মায়ার চোখে অয়ন যা খুঁজে পেল, তা শুধু এক প্রার্থনা—তুমি থেকো পাশে!

শহরের কোলাহলের ভেতরেও অয়ন সবসময় যেন একটু আলাদা।
কলকাতার উত্তর প্রান্তে পুরনো এক বাড়িতে বাবা-মা’কে নিয়ে থাকে সে। পড়াশোনায় ভালো, কিন্তু মনটা সবসময় কোথাও অন্যখানে ঘুরে বেড়ায়। বইয়ের পাতায় ডুবে থাকা, কিংবা জানলার বাইরে তাকিয়ে আকাশের ভেসে যাওয়া মেঘ গুনে সময় কাটানো—এমনটাই তার অভ্যাস।

অয়নের বাবা সরকারি অফিসে চাকরি করেন। একেবারে নিয়মমাফিক জীবন। মা গৃহিণী। সংসারে অভাব নেই, কিন্তু বাড়তি বিলাসও নেই। তবে একটাই সমস্যা—অয়নের অন্তর্মুখী স্বভাব। বাইরে সবাই বলে, “ছেলেটা কেমন যেন একলা একলা থাকে, খুব কম কথা বলে।” অথচ অয়নের ভেতরে চলতে থাকে একের পর এক গল্প, কল্পনা আর অদ্ভুত স্বপ্ন।

গ্রীষ্মের ছুটিতে মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল এবার। মামাবাড়ি গ্রামে—নদীর ধারে, সবুজ ধানখেতের মাঝখানে। ছোটবেলায় কয়েকবার গিয়েছিল, কিন্তু বহু বছর পর আবার সেখানে ফেরা। মায়ের ভেতরে একধরনের আনন্দ, বাবার ছুটির অভাবের কারণে তিনি যাচ্ছেন না, তাই ছেলে অয়নকে সঙ্গী করে নিয়েছেন।

ট্রেন ছাড়ল সকালে। সল্টলেক থেকে শিয়ালদহ, তারপর সেখান থেকে দীর্ঘ যাত্রা। ট্রেনের হুইসেল বাজতেই অয়ন জানলার ধারে বসে বাইরে তাকিয়ে রইল। শহরের বাড়িঘর, বিলবোর্ড, গলির ভিড় ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গেল। তার জায়গা নিল সবুজ গাছপালা, মাঠ আর নদীর রেখা। অয়ন গভীর শ্বাস নিয়ে মনে মনে বলল, “কী শান্ত লাগছে! এখানে এলে মনে হয় সত্যি নিজের মতো করে বাঁচা যায়।”

মা ব্যাগ থেকে লুচি-আলুরদম বের করে দিলেন। অয়ন হেসে নিল, কিন্তু খাওয়ার চেয়ে তার চোখ ব্যস্ত বাইরের দৃশ্য দেখায়।

সন্ধ্যার আগেই তারা পৌঁছল মামাবাড়ি। পুরনো দোতলা টালির চালের বাড়ি, চারপাশে উঠোন, তালগাছ, আর ডানদিকে পুকুর। মামা-মামী, মামাতো ভাইবোন সবাই মিলে খুশির হইচই। অয়ন কিছুটা অপ্রস্তুত—সে আসলে ভিড় খুব একটা পছন্দ করে না। তবে মামার ছোট মেয়ে, রিয়া, তাকে টেনে নিয়ে গেল উঠোনে খেলতে।

সেদিন রাতেই খাওয়াদাওয়ার পর অয়ন একা বসেছিল বারান্দায়। আকাশে ছিল অসংখ্য তারা। শহরে এমন দৃশ্য সে কবে দেখেছে মনে করতে পারল না। হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে শোনা গেল মিষ্টি গলার গান—“ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল…”। অয়ন চমকে তাকাল। কণ্ঠস্বরটা যেন তাকে একেবারে থমকে দিল।

sudhu tumi theko pase 1 parba 1 pic

সে দেখল—পাশের বাড়ির ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে এক মেয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছে। আলো অন্ধকারের ফাঁকে মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু কণ্ঠস্বরের টানে অয়নের বুক কেঁপে উঠল।

সে জানত না, এটাই তার জীবনের প্রথম দেখা—মায়ার সঙ্গে।

পরের দিন ভোরেই অয়ন উঠে পড়েছিল। শহরে থেকে থেকে তার ভোরবেলা উঠার অভ্যাস প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু গ্রামের শান্ত পরিবেশে অদ্ভুত এক প্রশান্তি তাকে ঘিরে ধরেছিল। চারদিকে কেবল কাকের ডাক, দূরে ভেসে আসা ভোরের আজানের সুর, আর টাটকা ঘাসের গন্ধ।

অয়ন হাঁটতে হাঁটতে বেরোল মাঠের দিকে। চারপাশে ঝোপঝাড়, কাঁচা রাস্তা, ভোরের কুয়াশায় ভিজে থাকা গাছের পাতা। হাঁটতে হাঁটতেই সে গেল গ্রামের পুকুরপাড়ে। সেখানে দু–একজন জেলে মাছ ধরছে, কয়েকজন মহিলা কলসি নিয়ে জল তুলছে।

সেই সময় হঠাৎ শুনতে পেল পরিচিত কণ্ঠস্বর।
কাল রাতে যে গানের সুরে তার বুক কেঁপে উঠেছিল, আজ সেই একই গলা ভেসে আসছে কাছেই।

অয়ন ঘুরে তাকাল। পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে। পরনে সাদা-নীল স্কুলড্রেস, চুল বেণী করা, হাতে খাতা–কলম। মনে হচ্ছে, স্কুলে যাবার আগে পড়াশোনা ঝালিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ঠোঁটে আবারও গান ভেসে উঠছে—খুব মিষ্টি, সুরেলা।

sudhu tumi theko pase 1 parba 2 pic

অয়ন এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সাহস করে এগিয়ে গেল।
“এই যে… গানটা খুব সুন্দর। তুমি গাইছ তো?”

মেয়েটি একটু চমকে তাকাল। বড় বড় কালো চোখ, মুখে সরল হাসি।
“হ্যাঁ, কিন্তু… তুমি কে?”

অয়ন সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “আমি অয়ন। পাশের বাড়িতে এসেছি মামার কাছে। কাল রাতে তোমার গান শুনছিলাম। অসাধারণ লেগেছে।”

মেয়েটির মুখে লাজুক হাসি ফুটল।
“আমি মায়া। এই গ্রামেই থাকি। গান আমার খুব প্রিয়।”

দুজনের চোখে চোখ পড়তেই যেন অদৃশ্য এক সেতু গড়ে উঠল। অয়ন অনুভব করল, মায়ার সেই চোখে এক অদ্ভুত গভীরতা আছে—যেন হাজার গল্প লুকিয়ে আছে ভেতরে।

মায়া খাতা বন্ধ করে বলল,
“তুমি কি গান শোনো?”

অয়ন একটু হেসে মাথা নাড়ল,
“শুনি… তবে গাইতে পারি না। শুনতে ভালোবাসি।”

তাদের আলাপ ধীরে ধীরে দীর্ঘ হলো। গ্রামের সকাল, পুকুরের নরম ঢেউ, কুয়াশা ভেদ করে ওঠা সূর্যের আলো—সবকিছু যেন মুহূর্তটাকে বিশেষ করে তুলল।

মায়া জানাল, সে স্থানীয় স্কুলে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। গান শেখে পাশের শহরে গিয়ে। স্বপ্ন একদিন গায়িকা হবে।
অয়ন শুনছিল মুগ্ধ হয়ে। তার মনে হচ্ছিল, “এই মেয়ে যেন একেবারে অন্যরকম। শহরের মেয়ে হলে হয়তো এত সহজ, এত আন্তরিক হতো না।”

হঠাৎ মায়ার বড় ভাই রূপম দূর থেকে ডাক দিল,
“মায়া! দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলো স্কুলে!”

মায়া তাড়াহুড়ো করে খাতা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। যাবার আগে হেসে বলল,
“আবার কথা হবে অয়ন।”

অয়নের বুকের ভেতর অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল।
সে নিজেও বুঝতে পারছিল না—এটা কি কেবল নতুন পরিচয়ের আনন্দ, নাকি এর মধ্যেই এক অদৃশ্য টান জন্ম নিচ্ছে।

মায়া চলে গেল। অয়ন দাঁড়িয়ে রইল পুকুরপাড়ে, বাতাসে ভেসে থাকা তার গানের সুরে মগ্ন হয়ে।

অয়নের গ্রামে আসার দিনগুলো যেন একেবারেই বদলে দিল তার প্রতিদিনের জীবন। শহরে সারাক্ষণ চারপাশে কোলাহল, যন্ত্রের শব্দ, হর্নের চিৎকারে সে ক্লান্ত হয়ে যেত। এখানে সকালটা শুরু হয় পাখির ডাক দিয়ে, দুপুরটা কাটে গাছের ছায়ায়, আর সন্ধ্যা নামে কাঁসরের ঘণ্টাধ্বনি ও ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে।

সবচেয়ে বড় বদলটা হলো—মায়া।

প্রথম আলাপের পর থেকে দুজনের দেখা হতে লাগল প্রায় রোজই। কখনও পুকুরপাড়ে, কখনও মাঠে, কখনও আবার স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ মুখোমুখি। মায়া খুবই প্রাণবন্ত। তার হাসি, তার সহজ সরল কথা—সবকিছুতে অয়ন অদ্ভুত এক প্রশান্তি খুঁজে পেত।

একদিন দুপুরে মায়া অয়নকে নিয়ে গেল তাদের বাড়ির আমবাগানে। মায়ার হাতে ছোট্ট একখানা ডায়েরি। সে বলল,
“এখানে আমি আমার গান লিখে রাখি। মাঝে মাঝে নিজের মনের কথা লিখি।”

sudhu tumi theko pase 1 parba 3 pic

অয়ন অবাক হয়ে পাতাগুলো উল্টে দেখছিল। অক্ষরে অক্ষরে যেন ঝরে পড়েছে মায়ার মন।
একটা পাতায় লেখা ছিল—
“গান আমার শ্বাস, আমার স্বপ্ন। যদি কোনোদিন গাইতে না পারি, তবে মনে হবে বেঁচে আছি অথচ বাঁচছি না।”

অয়ন মায়ার দিকে তাকাল। বলল,
“তুমি জানো মায়া, তুমি অন্যরকম। শহরে অনেক ছেলেমেয়েকে দেখেছি, কিন্তু এমন নিখাদ স্বপ্ন আমি দেখিনি।”

মায়া একটু হেসে বলল,
“স্বপ্ন না থাকলে মানুষ বাঁচে কীভাবে বলো তো?”

অয়ন উত্তর দিতে পারল না। তার মনে হলো, এই মেয়ে যেন তাকে নিজের ভেতরের ঘুমন্ত স্বপ্নগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে।

দিন কেটে যাচ্ছিল। মায়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে অয়ন নিজেকে অন্যরকমভাবে আবিষ্কার করছিল। হয়তো এটাই প্রথম ভালো লাগা, হয়তো বন্ধুত্বের চেয়ে গভীর কিছু। কিন্তু সে মুখে কিছু বলত না। কেবল মায়ার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর প্রতিদিন তার ভেতরে অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে যেত।

এক সন্ধ্যায় গ্রামের মেলায় গেল তারা। আলোর রঙিন ঝলকানি, মিষ্টির দোকান, নাগরদোলা—সব মিলিয়ে জমজমাট। মায়া টান দিয়ে অয়নকে বলল,
“চলো, নাগরদোলায় উঠব।”

অয়ন ভয়ে ভয়ে রাজি হলো। দুজনে একসঙ্গে বসতেই নাগরদোলা ঘুরতে শুরু করল। ওপরে উঠতেই পুরো গ্রামটা নিচে ছড়িয়ে পড়ল। বাতাসের ঝাপটা মুখে এসে লাগল। মায়ার খোলা চুল বাতাসে উড়তে লাগল। অয়ন তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল, “এই মুহূর্তটা যদি থেমে যেত!”

মায়া হেসে বলল,
“কী দেখছো এভাবে?”

অয়ন সোজা উত্তর দিল না। শুধু জানল—এই হাসিটাই তার মনে চিরকালের জন্য গেঁথে গেল।

তবে সবসময় যে সবকিছু সহজ ছিল, তা নয়। মায়ার ভাই রূপম প্রায়ই তাকে সাবধান করত।
“মায়া, ওই শহুরে ছেলের সঙ্গে এত কথা বলার দরকার নেই। ও তো কয়েক দিনের অতিথি। আবার চলে যাবে। এরপর তুমি কষ্ট পাবে।”

মায়া চুপ করে থাকত, কিন্তু মনে মনে জানত—অয়ন আলাদা।

একদিন সন্ধ্যায় অয়ন চলে যাচ্ছিল মাঠের দিক দিয়ে। হঠাৎ পেছন থেকে মায়ার ডাক—
“শোনো!”

অয়ন দাঁড়িয়ে গেল। মায়া দৌড়ে এসে বলল,
“আজ তোমাকে কিছু বলব। জানো, আমার মনে হয় তুমি শহরে না থেকে এখানে থাকলে ভালো হতো। তুমি তো আসলেই গ্রামের মতো শান্ত, শহরের ভিড়ের ভেতর তোমাকে মানায় না।”

অয়ন হাসল।
“তুমি কি চাও আমি এখানে থেকে যাই?”

মায়া হেসে চোখ নামিয়ে বলল,
“কেন জানি না… মনে হয় তোমাকে না দেখলে আমার দিনটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।”

এই কথাগুলো শুনে অয়নের বুক ধক করে উঠল। সে বুঝতে পারল—এটা আর শুধু বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।

সেই রাতে বারান্দায় বসে অয়ন আকাশের তারাগুলো গুনছিল। মনে মনে বলল,
“প্রথম দেখা… অথচ মনে হচ্ছে কতদিনের চেনা। তুমি যেন আমার নিঃশ্বাসের মতো মায়া। শুধু তুমি থেকো পাশে…”

তার যাত্রার প্রথম পর্ব এখানেই শেষ হলো, কিন্তু গল্পের পথ তখনও অনেক দীর্ঘ।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *