ভোরের কুহেলিকা
নদীর ধারের সেই ভোর
শীতের ভোর।
আকাশে রঙিন আভা ফোটার আগেই নদীর ধারে হালকা ভোরের কুয়াশা নামতে শুরু করেছে। দূরের চর থেকে ভেসে আসছে পাখির ডাক—শালিক, বক, আর কাকের একসঙ্গে মিলেমিশে তৈরি করা এক অদ্ভুত সকালসকাল-সিম্ফনি।
নদীর জল টলটল করছে হালকা স্রোতে, মাঝে মাঝে বুদবুদ তুলে উঠছে ছোট মাছেরা। ঘাটের ধারে বাঁধা নৌকাগুলো দুলে উঠছে ঠান্ডা বাতাসে। নদীর ওপারে দূরের সবুজ শাকসবজির ক্ষেতে ভোরের শিশির জমে মুক্তোর মতো ঝিকমিক করছে।
এই দৃশ্যের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট রূপা—বয়স দশ, চোখে কৌতূহলের ঝিলিক, পরনে মলিন কিন্তু পরিষ্কার নীল ফ্রক। তার হাতে বাঁশের তৈরি ছোট্ট এক খেলার বঁড়শি, যা দিয়ে সে মাঝে মাঝে পুঁটি মাছ ধরতে চায়, যদিও বেশিরভাগ সময় কিছুই জোটে না।
পেছন থেকে মায়ের কোমল ডাক—
— “রূপা, চলো মা, তোমার স্কুলে যাবার সময় হয়ে গেছে।”
মায়ের গলায় ছিল এক ধরনের স্নিগ্ধ সুর, যা শীতের ভোরের কুয়াশার ভেতর দিয়েও রূপার কানে উষ্ণতা এনে দিত।
বাবা তখন নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে জাল ফেলছে। গায়ে পুরনো গামছা, কপালে ঘাম জমে ছোট ছোট বিন্দু তৈরি হয়েছে ঠান্ডা সত্ত্বেও। মাঝে মাঝে সে রূপার দিকে তাকিয়ে হাসি ছুঁড়ে দেয়—একটা হাসি, যেখানে ছিল স্বপ্ন, আশ্বাস আর ভরসা।
রূপার মনে ছিল একটাই স্বপ্ন—বড় হয়ে সে শহরের স্কুলে পড়বে, বড় বইয়ের লাইব্রেরিতে যাবে, আর বাবার জন্য বড় নৌকা কিনে দেবে।
সকালটা যেন ছিল শান্তি, ভালোবাসা আর নিরাপত্তায় মোড়া।
কিন্তু রূপা তখনও জানত না—নদীর এই শান্ত জলরাশির নিচে লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য স্রোত, যা শিগগিরই তাকে টেনে নিয়ে যাবে এমন এক পথে, যেখান থেকে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব…
বন্যার রাত
আষাঢ়ের শেষ সপ্তাহ।
সারা দিন আকাশ ছিল ভারী কালো মেঘে ঢাকা। দুপুরের পর থেকে গুমোট গরমে চারদিক যেন দম বন্ধ করে রেখেছে। পাখিরা গাছের ডালে নিশ্চুপ, আর গবাদি পশুরা খোঁয়াড়ে অস্থির হয়ে উঠেছে।
সন্ধ্যার পর প্রথম বজ্রপাত আকাশ চিরে ফেলল—তারপর শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি।
বৃষ্টি যেন থামতেই চাইছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আকাশ থেকে জল ঝরছে নদীর বুকের উপর, আর নদী ধীরে ধীরে ফুলে উঠছে।
রূপা তখন মায়ের পাশে বসে ভাত খাচ্ছিল। মাটির ঘরের চালের ফাঁক দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। বাবা এক দম দিয়ে কেরোসিনের লণ্ঠন জ্বালালেন, আর কপালের ভাঁজ আরও গভীর হলো।
— “নদীটা খারাপ রূপ নিচ্ছে… এমন বৃষ্টি অনেক বছর দেখিনি,” বাবা মৃদু গলায় বললেন।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসও বেড়ে গেল। ঝোড়ো হাওয়া চালের টিনগুলো কাঁপিয়ে তুলছে, দরজার ফাঁক দিয়ে শীতল বাতাস ঢুকে মোমবাতির আলো দুলিয়ে দিচ্ছে। দূরে নদীর গর্জন ক্রমে আরও তীব্র হয়ে উঠছে—যেন কোনো অজানা আতঙ্ক এগিয়ে আসছে।
মাঝরাতের কিছু আগে হঠাৎ বাবার চিৎকার—
— “জল ঢুকে পড়েছে! সবাই উঠে পড়ো!”
রূপা বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল, উঠোনের জল হাঁটুর সমান হয়ে গেছে। বৃষ্টির শব্দ, ঝড়ের হাহাকার আর মানুষের চিৎকারে চারদিক ভরে গেছে।
বাবা তাড়াহুড়ো করে একটা বাঁশের ডোলা কাঁধে তুলে নিলেন, মা তাড়াতাড়ি কিছু কাপড় ও চালের হাঁড়ি বেঁধে রাখলেন।
— “রূপা, আমার হাত শক্ত করে ধরো!” মা বললেন কাঁপা গলায়।
গ্রামের সবাই দল বেঁধে উঁচু জমির দিকে এগোতে লাগল। রাতের অন্ধকারে শুধু কেরোসিনের লণ্ঠন আর বজ্রপাতের আলোতে ভেসে উঠছে ভীতসন্ত্রস্ত মুখগুলো। চারদিকের জলেতে ভেসে যাচ্ছে গরু, মুরগি, গাছের ডাল, ঘরের চালা…
হঠাৎ রূপা দেখল—মা খুব ধীরে হাঁটছেন, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর যেন আগুন জ্বলছে তাঁর। বাবা বারবার জিজ্ঞেস করছেন—
— “তুমি ঠিক আছো তো?”
কিন্তু মা শুধু মাথা নেড়ে উত্তর দিচ্ছেন, কথা বেরোচ্ছে না।
অবশেষে তারা এক উঁচু বাঁধে উঠল, কিন্তু তখনও বৃষ্টি থামেনি। সবাই ভিজে কাপড়ে ঠান্ডায় কাঁপছে। রূপা মায়ের গা ঘেঁষে বসেছে, কিন্তু মায়ের হাত ক্রমশ শীতল হয়ে যাচ্ছে।
ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই মা চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে চলে গেলেন।
বাবার চোখে তখন শুধু শূন্যতা—যেন নদীর গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভেতরের সমস্ত আলোও ভেসে গেছে।
শহরের অন্ধকার গলি
বন্যার পর গ্রামের জীবন যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে ভোর ছিল অন্য রকমের ভোর।
মায়ের মৃত্যুর পর বাবা হয়ে গেলেন নীরব, গম্ভীর মানুষ। নদীতে মাছ কমে গেছে, কাজের অভাব, আর ঘরে খাবার নেই।
প্রতিদিন বাবার চোখে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা যেত। অবশেষে একদিন বিকেলে তিনি রূপাকে বললেন—
— “তুমি শহরে যাবে? এক আত্মীয় আছেন, তোমার পড়াশোনার ব্যবস্থা করবেন। আমি আর পারছি না।”
রূপা তখনও বুঝতে পারেনি বাবার কণ্ঠে থাকা শীতলতা। সে ভেবেছিল—এটাই হয়তো তার স্বপ্নের পথে প্রথম ধাপ।
শহরে যাত্রা
পরের দিন সে ভোর ভোর তৈরি হয়ে সকালে একটি পুরনো বাসে চড়ে তারা শহরে রওনা দিল। প্রথমবার এত মানুষের ভিড়, উঁচু উঁচু বিল্ডিং, রঙিন দোকান দেখে রূপার চোখ বিস্ময়ে ভরে গেল।
বাবা তাকে নিয়ে এক সরু গলির ভেতরে ঢুকলেন। গলির মাথায় এক সাইনবোর্ড—“মঙ্গল লজ”—কিন্তু জায়গাটা কোনো লজের মতো লাগছিল না। ভেতরে বাজছিল উচ্চস্বরে গান, আর রঙিন আলো জ্বলছে নিভছে।
সামনে এগোতেই বেরিয়ে এল এক নারী, বয়স পঁইত্রিশের কাছাকাছি, ঠোঁটে উজ্জ্বল লাল লিপস্টিক, চোখে গাঢ় কাজল। তিনি রূপাকে একবার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখলেন, তারপর বাবার সঙ্গে নিচু গলায় কিছু কথা বললেন।
এরপর বাবা রূপার মাথায় হাত রেখে বললেন—
— “তুমি এখানেই থাকবে, ওরা তোমার যত্ন নেবে।”
রূপা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল—
— “আপনি ফিরবেন কবে?”
বাবা শুধু বললেন—
— “তুমি ভালো থাকবে”—এবং পেছন ফিরে চলে গেলেন।
প্রথম রাত
রূপা বুঝে উঠতে পারছিল না কী হচ্ছে। সেই নারী তাকে নিয়ে গেল এক ছোট ঘরে—জানালায় মোটা পর্দা, দেয়ালে উজ্জ্বল রঙ, আর কোণায় সাজানো অনেক রঙিন পোশাক।
রাত নামতেই দরজায় কড়া পড়ল। সেই নারী ফিসফিস করে বলল—
— “এখন থেকে তুমি এখানে কাজ করবে।”
রূপা ভয় পেয়ে বলল—
— “কোন কাজ?”
কিন্তু উত্তর আসার আগেই দরজা খুলে ঢুকে পড়ল এক অচেনা পুরুষ।
সেই রাতের পর রূপার পৃথিবী ভেঙে গেল।
শিশু বয়সের সমস্ত স্বপ্ন, বাবা-মায়ের স্নেহ, নদীর পাড়ের সকালের রোদ—সব যেন এক ঝটকায় নিভে গেল।
নতুন বাস্তবতা
দিনগুলো বদলে গেল। রূপা শিখে গেল কীভাবে মুখে হাসি রাখতে হয়, কীভাবে কান্না লুকাতে হয়, কীভাবে ভিড়ের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হয়।
গলির ভেতর দিন মানে ঘুম, রাত মানে কাজ। বাইরে শহরের মানুষ হাসে, কেনাকাটা করে, প্রেমে পড়ে—আর এখানে রঙিন আলোর নিচে মানুষের মুখ বদলাতে থাকে, কিন্তু চোখের শূন্যতা একই রকম থেকে যায়।
প্রথম প্রথম রূপা দরজা ভেঙে পালানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রতিবারই তাকে ধরে আনা হতো, আর শাস্তি দেওয়া হতো। ধীরে ধীরে সে বুঝল—এখান থেকে বেরোনো সহজ নয়।
এই গলিতেই রূপা শিখল—
“এখানে বেঁচে থাকা মানেই প্রতিদিন এক নতুন যুদ্ধ।”
বছরের পর বছর
প্রথম বছরটা রূপার কাছে ছিল নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা এক অন্ধকার গুহার মতো।
নতুন জায়গা, অচেনা মুখ, আর শরীরকে জোর করে কাজে লাগানো—সবকিছু মিলিয়ে সে নিজেকে বন্দি পাখির মতো অনুভব করত।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্দি পাখিও জানে, খাঁচার ভেতরেও বেঁচে থাকতে হয়।
প্রথম মানিয়ে নেওয়া
রূপা শিখে ফেলল—
হাসতে হয় যখন মন কাঁদছে
কথা বলতে হয় যখন গলায় শব্দ আটকে যাচ্ছে
সাজগোজ করতে হয়, যদিও আয়নায় নিজের মুখ দেখলেই গা ঘিনঘিন করে
দিনে ঘুম, রাতে কাজ—এটাই হয়ে উঠল রুটিন। গলির বাইরে পৃথিবী চলে নিজের নিয়মে, কিন্তু এখানে সূর্য ওঠে রাতের পর্দা নামানোর জন্য।
বন্ধুত্ব ও হারিয়ে যাওয়া
এই গলিতে রূপার একমাত্র সান্ত্বনা ছিল কিছু মেয়ে, যারা একই ভাগ্য নিয়ে এখানে এসেছে। কারও বয়স কম, কারও বেশি, কিন্তু সবার চোখে এক রকমের শূন্যতা।
রূপা একসময় ঘনিষ্ঠ হয়েছিল লীলা নামের এক মেয়ের সঙ্গে। লীলা হাসতে পারত খুব সুন্দর করে, আর রাতের কাজ শেষে তারা একসঙ্গে ছাদে বসে আকাশ দেখত।
লীলা একদিন বলেছিল—
— “জানিস, আমি ঠিক পালাবো। অন্য শহরে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করব।”
কিন্তু সেই রাতেই লীলাকে এক ক্রেতা নিয়ে গেল… আর আর কখনও ফেরত আনল না।
রূপা প্রথমবার অনুভব করল—এখানে মানুষও হারিয়ে যায় ঠিক যেমন নদীতে ভেসে যায় নৌকা।
শরীরের সঙ্গে সঙ্গে ভাঙতে থাকা মন
পাঁচ বছর, সাত বছর, দশ বছর… সময় যেন গুনে রাখা অসম্ভব হয়ে গেল।
মুখে বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করল, কিন্তু চোখের ক্লান্তি আরও গভীর হলো।
কখনও কখনও রূপা রাতে ঘুম ভেঙে কেঁদে ফেলত, মনে পড়ত মায়ের কথা, বাবার সেই শূন্য চোখ, আর নদীর ধারের সেই শান্ত ভোরের সকাল।
কিন্তু চোখ মুছে আবার কাজে নামতে হতো—কারণ এই গলিতে কান্না মানে দুর্বলতা, আর দুর্বলদের জন্য এখানে কোনো জায়গা নেই।
মনের ভেতরে ছোট্ট আগুন
তবুও, সব হারিয়ে গেলেও রূপার ভেতরে একটা ছোট্ট আগুন জ্বলে রইল—একদিন এই গলি ছেড়ে বেরোতে হবে।
প্রতিদিন নতুন মেয়েদের দেখে মনে হতো—যদি কাউকে অন্তত এই জীবন থেকে বাঁচানো যায়!
সে চুপিচুপি কিছু মেয়েকে পড়তে শেখাত। একবার এক গ্রাহক রেখে যাওয়া পুরনো পত্রিকা থেকে অক্ষর চিনে নিল। ছোট ছোট খাতায় লিখে রাখত বাংলা বর্ণমালা।
এই ছোট কাজগুলোই যেন তার কাছে বিদ্রোহের মতো ছিল—অন্ধকারের মাঝখানে নিজের মতো করে আলো জ্বালানো।
বছরের পর বছর এই গলিতে কাটাতে কাটাতে রূপা বুঝে গিয়েছিল—
“এখানে বেঁচে থাকা মানেই কেবল শরীরের লড়াই নয়, মনকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।”
ছোট্ট আলো
গলির জীবন অনেকটা থেমে যাওয়া ঘড়ির মতো—এখানে দিন আর রাত একইভাবে ঘোরে, শুধু মুখ বদলায়।
কিন্তু একদিন সেই নির্জীব ঘড়ির কাঁটা যেন একটু নড়ল।
মুন্নির আগমন
এক দুপুরে রূপা শুনল, গলির প্রধান নারী মালকিন নতুন এক মেয়েকে নিয়ে এসেছে।
মেয়েটির বয়স বারো বছরের বেশি হবে না, চেহারায় ভীষণ ভয়ের ছাপ, পরনে ময়লা সালোয়ার-কামিজ।
মালকিন বিরক্ত স্বরে বলল—
— “এটাকে ঠিক করে সাজিয়ে দে, কাল থেকে কাজ শিখবে।”
রূপা কাছে গিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল—
— “তোর নাম কী?”
মেয়েটি কাঁপা গলায় বলল—
— “মুন্নি… আমাকে বলে ছিল কাজের মেয়ে বানাবে… কিন্তু…”
বাকি কথাটা গিলে ফেলল সে।
রূপার বুক কেঁপে উঠল। নিজের দশ বছরের বয়সটা হঠাৎ যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল—নদীর ধারের সকাল, বাবার হাত, আর সেই অন্ধকার গলিতে প্রথম রাত।
এক অদৃশ্য প্রতিজ্ঞা
সেই মুহূর্তেই রূপা মনের ভেতরে প্রতিজ্ঞা করল—যেভাবেই হোক, মুন্নিকে এই জীবন থেকে বাঁচাতে হবে।
সে মালকিনকে বলল—
— “এটাকে প্রথমে আমার ঘরে রাখো, আমি সামলাবো।”
মালকিন রাজি হয়ে গেল, কারণ রূপা গলির পুরনো এবং বিশ্বস্ত মুখ।
গোপন শিক্ষা
দিনের বেলা গলিতে যখন সবাই ঘুমায়, রূপা মুন্নিকে ছোট্ট খাতা আর পেন্সিল দিয়ে বসাত।
প্রথম দিন মুন্নি লিখল—
“আমার নাম মুন্নি। আমি বাড়ি যেতে চাই।”
এই লাইনটা দেখে রূপার চোখে জল চলে এল।
সে মুন্নিকে শেখাতে লাগল অ, আ, ক, খ… পাশাপাশি বলত—
— “শিখে রাখিস, পড়াশোনা মানুষকে মুক্তি দেয়।”
ছোট্ট হাসি, বড় শক্তি
মুন্নির হাসি ধীরে ধীরে ফিরতে লাগল।
সে কাপড় সেলাই শিখতে শুরু করল, রূপার সাথে রান্না করত, আর রাতে কাজের ভান করে চুপচাপ নিজের ঘরে থাকত।
রূপার কাছে এই হাসি ছিল অন্ধকারের মধ্যে জ্বলে ওঠা একটি ছোট্ট প্রদীপের মতো—যা দেখিয়ে দিচ্ছিল, এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি।
আশার শুরু
রূপা জানত,মুন্নিকে বাঁচানো সহজ হবে না।
কিন্তু একবার যদি সে পারে, তাহলে হয়তো অন্যদের জন্যও পথ খুলে যাবে।
মনের ভেতরে এক অদ্ভুত সাহস জন্ম নিচ্ছিল—যেন কুয়াশার ভেতর দিয়েও ভোরের প্রথম আলো ফুটে উঠছে।
এনজিওর সঙ্গে দেখা
গলির স্যাঁতসেঁতে বাতাসে সেদিন যেন অদ্ভুত এক আলো এসে পড়েছিল। ময়লার গন্ধ, ধোঁয়া আর ভাঙাচোরা দেওয়ালের মাঝেই হঠাৎ ভেসে উঠল এক অপরিচিত মুখ—নীরা। সাদা শাড়ি, কাঁধে একটা বড় ব্যাগ, চোখে একরাশ মমতা। তিনি একজন এনজিও কর্মী, এখানে মেয়েদের স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতা বাড়াতে এসেছেন।
রূপা দূর থেকে তাকিয়ে ছিল। এত বছর ধরে কত লোক এসেছে-গিয়েছে, কিন্তু কারও চোখে এমন কোমল দৃষ্টি দেখেনি সে। সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গিয়ে বলল—
— “আপনি যদি চান, আমি অন্য মেয়েদেরও বুঝিয়ে দিতে পারি… শুধু আমাকে একটু সাহায্য করুন।”
নীরা থমকে গেলেন। এই মেয়েটির কণ্ঠে লুকোনো দুঃখ আর অদম্য ইচ্ছা তাকে ছুঁয়ে গেল। ধীরে জিজ্ঞেস করলেন—
— “তুমি কি এই জীবন ছাড়তে চাও?”
রূপার চোখে তখন জল চিকচিক করছে, কিন্তু কণ্ঠ দৃঢ়—
— “শুধু আমি না… এখানে অনেকেই চায়। কিন্তু পথ জানে না।”
নীরার মনে হল, এই মেয়েটি কেবল নিজের মুক্তির কথা ভাবছে না—সে অন্যদেরও টেনে তুলতে চায়। সেই মুহূর্তে তাদের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য বন্ধন গড়ে উঠল—
আশার, বিশ্বাসের আর এক নতুন লড়াইয়ের বন্ধন।
আশ্রয়গৃহের স্বপ্ন
কয়েক মাসের মধ্যে নীরা শহরের এক প্রান্তে একটা ছোট বাড়ি ভাড়া নিলেন—যেখানে যে মেয়েরা গলি ছাড়তে চায়, তারা এসে থাকতে পারবে।
রূপা সেখানে সেলাই শিখতে শুরু করল। নিজের হাতে বানানো ব্যাগ, থলে, কাপড় বিক্রি করে সামান্য আয় হতে লাগল।
মুন্নিও আশ্রয় পেল সেখানে। ধীরে ধীরে আরও ৫-৬ জন মেয়ে যোগ দিল।
পুরনো গলিতে ফেরা
রূপা মাঝে মাঝে পুরনো গলিতে ফিরে যেত—কাউকে টেনে আনার জন্য নয়, বরং যারা যেতে চায় তাদের সাহস দেওয়ার জন্য।
অনেকেই বলত—
— “এখান থেকে বেরিয়ে গেছ, আবার ফিরছ কেন?”
রূপা হাসত—
— “যেখানে আমি একদিন হারিয়ে গিয়েছিলাম, সেখান থেকেই তো কাউকে খুঁজে বের করব।”
নতুন ভোর
শীতের এক মায়াময় ভোরের সকাল। বাইরে ঘন কুয়াশা, যেন পৃথিবী এখনো আধো ঘুমে। কিন্তু কুয়াশার আড়াল ভেদ করে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে সূর্যের প্রথম আলো।
আশ্রয়গৃহের বারান্দায় বসে রূপা হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ। চারপাশে মেয়েরা হাসছে, কেউ সেলাই করছে, কেউবা বইয়ের পাতায় হারিয়ে গেছে। এই হাসি, এই প্রশান্তি—তার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল।

রূপা অনুভব করল, আজ সে আর “পতিতা” নয়। আজ সে একজন যোদ্ধা—যে অন্ধকারকে পেরিয়ে এসেছে, এবং এখন অন্যদের জন্য পথ দেখাচ্ছে।
তার অতীতের কালো অধ্যায় হয়তো মুছে যাবে না, কিন্তু সেই অতীতের আগুনেই সে গড়েছে নিজের শক্তি, নিজের আলো।
হালকা হাসি মুখে নিয়ে রূপা নিজের মনে ফিসফিস করে বলল—
“অন্ধকার যত গভীরই হোক, ভোরের কুহেলিকা একদিন ভাঙবেই।”