আয়নাঘরের শয়তান ভূতের গল্প

“আয়নাঘরের শয়তান – একটি ভয়ানক বাংলা ভূতের গল্প”

ভাঙা আয়নার বাড়ি

“আয়নাঘরের শয়তান” একটি ভয়ানক বাংলা ভূতের গল্প। ঘনশ্যামপুরে দিনের আলো পড়ে একটু ম্লান, আর রাত যেন চুপচাপ একটা অভিশাপ বয়ে আনে। গ্রামের প্রান্তে, শাল-মেহগনির ঘন জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এক শতবর্ষী প্রাসাদ—রেভেনকোঠি

কেউ বলে ওটা ইংরেজ সাহেবদের বাংলো ছিল, কেউ বলে এক ইউরোপীয় চিত্রশিল্পী এই বাড়িতে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু গ্রামের লোকেরা জানে একটাই কথা—
“ও বাড়িতে শয়তান আয়নাআছে, যা মানুষ ধরে না, আত্মা ধরে!”

বাড়ির প্রবেশপথে লোহার গেটটা আধা খোলা। তার ওপর জং ধরে আছে, আর নিচে বুনো লতাপাতা পেঁচিয়ে উঠেছে। রাহুল ব্যানার্জি—একজন উদ্যমী রিপোর্টার ও প্যারানরমাল ব্লগার—নিজে দেখতে এসেছে সেই রহস্য।

পেছনে ড্রোন, GoPro ক্যামেরা, অডিও রেকর্ডার—সব রেডি। সে নিজের ব্লগ “অজানা দুনিয়া”-র জন্য বানাতে চায় এক্সক্লুসিভ একটি ভিডিও।
রাত তখন সাড়ে দশটা। চাঁদের আলোয় রেভেনকোঠি হাড়হিম করা এক ছায়ায় ঢাকা।

রাহুল দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢোকে।

ভিতরে একটা বিশাল হলঘর—ছাদ থেকে একটা আধাভাঙা ঝাড়বাতি ঝুলছে। মেঝেতে গুঁড়ো ধুলো, ইঁদুরের ছুটোছুটি আর হঠাৎ মাঝে মাঝে শব্দহীন শ্বাস।

ঘরের ডানদিকে একটা আয়না—ভাঙা। কাঁচের কিছু অংশ গায়েব, আর কিছু অংশে ঝাপসা কালো ছোপ।
রাহুল আয়নার সামনে দাঁড়াতেই একটু অস্বস্তি লাগে। যেন আয়নাটা তাকিয়ে আছে তার চোখের দিকে।

সে ক্যামেরা চালু করে বলে,
“ঘনশ্যামপুরের রেভেনকোঠি, সেই জায়গা যেখানে গত ১৩৪ বছরে ৭ জন লোক নিখোঁজ। আজ রাতে আমি এখানে থাকবো। যদি কিছু ঘটে… সে ইতিহাস হবে!”

আয়নায় হঠাৎ এক ঝলক যেন একটা চুল-ঢাকা মুখ দেখা গেল… কিন্তু পেছনে তো কেউ নেই!

রাহুল থমকে গেল। আয়নার দিকে এগিয়ে গেল কয়েক পা।

হঠাৎ কাঁচের নিচ থেকে খসখস শব্দ, আর একটা মেয়েলি গলা ফিসফিস করে বলে উঠল—
“তুমি দেখতে পাচ্ছো… তাই না?”

রাহুল ঘাড় ঘোরায়। পেছনে কেউ নেই। কিন্তু আয়নায়?
এক জোড়া ফাঁকা চোখ তাকিয়ে আছে ওর চোখে। ঠোঁট নড়ে উঠছে।

সে বুঝতে পারে—শয়তান আছে রাতটা স্বাভাবিক হবে না।

“আমি তো এখানে বন্দী…”

(গল্প: আয়নাঘরের শয়তান)

রাত তখন এগারোটা পেরিয়েছে। রেভেনকোঠির চারদিকে ঘন নীরবতা। শুধু মাঝে মাঝে পেছনের বাগানের কুকুরগুলো হঠাৎ করে চেঁচিয়ে ওঠে, যেন তারা কিছু অদৃশ্যকে দেখছে।

রাহুল ব্যানার্জি দোতলায় উঠে আসে। দেওয়ালে ধুলো মাখা পুরনো সব ছবি—একজন ইংরেজ মহিলার, গলায় মুক্তোর মালা, চোখে বিষণ্নতা। নিচে লেখা “Angela Morrison – 1889”। ছবির ফ্রেমে হালকা আঁচড়ের দাগ, যেন কেউ নখ দিয়ে আঁচড়াতে চেয়েছে।

ঠিক তার পাশেই একটা দরজা। ওপাশে অন্ধকার। টর্চের আলোতে ভেসে ওঠে কাঠের একটা চৌকাঠ, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে…
আয়নাটা!
আগের চেয়ে আরও পরিষ্কার, কিন্তু এইবার তার মধ্যে শুধু রাহুলের মুখ নয়—আরও একটা মুখ।

একটি মেয়ে, চোখ দুটো লালচে, গায়ের রং ম্লান, ঠোঁট রক্তশূন্য। চুলগুলো ভেজা ভেজা, যেন জলে ডুবে ছিল।
আর সে ফিসফিসিয়ে বলল—
“তুমি আমায় দেখতে পাচ্ছো… তাই না?”

রাহুল পিছিয়ে গেল, গলা শুকিয়ে গেল। সে ক্যামেরা বের করে ভিডিও শুরু করে।

“তুমি কে?”—রাহুল জিজ্ঞেস করে।

মেয়েটি আয়নার ভেতর থেকে বলে—
“আমি অ্যাঞ্জেলা। এই ঘরে আমাকে হত্যা করা হয়েছিল, বিয়ের ঠিক আগের রাতে। তারপর থেকে আমি… এখানে বন্দী।”

রাহুল কাঁপা গলায় বলে, “তোমার প্রতিচ্ছবি আছে, মানে তুমি—”

“না, আমি আর মানুষ নই। আমি এখন আয়নার অভিশাপ। যার চোখে আমি ধরা পড়ি, তার মধ্যেই আমি বাঁচি।”

হঠাৎ করেই আয়নার কাঁচে একটা ফাটল ধরে, যেন কারও থাবা ভিতর থেকে চাপ দিচ্ছে।

রাহুল পেছনে ঘুরে দেখে—ঘরের দরজা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। ক্যামেরা নিজের থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। ল্যাপটপ স্ক্রিনে টাইপ হতে লাগল নিজে থেকেই:

টর্চ নিভে যায়।

ঘরের শীতলতা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। রাহুলের শ্বাস যেন আটকে আসে।

ফিসফিস আওয়াজ…
“আমি তো এখানে বন্দী… এখন তোমার পালা!”

রাহুল হঠাৎ বুঝতে পারে, আয়নার ছায়া এখন আয়নার মধ্যে নেই…
সে তার পিছনে দাঁড়িয়ে আয়নাঘরের শয়তান

রাহুল ধীরে ধীরে ঘাড় ঘোরায়… কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

আয়নার ভেতরের গলা

(গল্প: আয়নাঘরের শয়তান)

ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক রাত ১২টা
রেভেনকোঠির দেয়ালে রাখা সেই থামা ঘড়ি, যেটা বহু বছর ধরে একবারও বাজেনি—হঠাৎ একটা কাঁপানো শব্দে “ডং” করে বেজে ওঠে।

রাহুল দৌড়ে বেরোতে চায়, কিন্তু দরজার কবজা যেন লোহায় মোড়া—নড়ে না। ঘরের সব আলো নিভে গেছে, শুধু আয়নার কাঁচে একটা নীলচে আলোর আভা।

সে আয়নার দিকে তাকায়…
এবং হতবাক হয়ে যায়।

আয়নায় সে দেখে নিজেকে নয়, দেখে একটা অন্ধকার ঘর, যেখানে দেয়ালের চারদিকে ঝুলছে শত শত আয়না। প্রতিটা আয়নায় একেকটা অদ্ভুত, বিকৃত মুখ—কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে, কেউ থাবা বাড়াচ্ছে আয়নার বাইরে।

সেই কণ্ঠস্বর আবার শোনা যায়—
“তুই আমায় দেখে ফেলেছিস, এখন তোকে ফিরতে হবে না। আয়নার ভেতরের ঘরটাই তোর জায়গা…”

রাহুল চিৎকার করে বলে,
“তুই কে? তুই চাস কী আমার থেকে?”

ঠিক তখনই আয়নার কাঁচের উপর ভেসে ওঠে রক্ত দিয়ে লেখা একটি বাক্য—

আবছা প্রতিচ্ছবিটা এবার সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়। মুখের চামড়া যেন গলে পড়ছে, চোখ দুটো ফাঁকা, কণ্ঠটা আরেকটু গভীর—
“আমি সেই যন্ত্রণা… যে আয়নার মধ্যে কাঁদে। আমাকে গলা টিপে মেরেছিল ওরা। এখন আমি শুধু গলা দিয়েই বাঁচি…” আমি আয়নাঘরের শয়তান

“বেঁচে থাকতে চাইলে নিজের গলা দাও, নয়তো আত্মা।”

রাহুল হতভম্ব, দিশেহারা। সে পেছনে তাকায়—ঘরের কোণায় রাখা একটা পুরনো রেকর্ডার নিজে থেকেই চালু হয়।
সেখানে শোনা যায় মেয়েলি কান্না আর ছেঁড়া-ছেঁড়া উচ্চারণ:

“আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম… কিন্তু ওরা আমার কথা বিশ্বাস করেনি। এখন তুমি যদি বিশ্বাস করো, তবে আমাকে মুক্তি দাও…”

রাহুল বুঝতে পারে—অ্যাঞ্জেলার আত্মা শুধু প্রতিশোধ নয়, মুক্তি চাইছে। কিন্তু মুক্তির দরজা একটাই—আর কেউ ঢুকলে, কেউ বেরোতে পারে।

হঠাৎ আয়নার গলা ভেঙে এক পলকেই ভেসে ওঠে একটি হাত—
শীতল, মৃত, রক্তাক্ত।
সে রাহুলের গলা জড়িয়ে ধরে।

তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সে চেষ্টা করে কিছু বলতে, কিন্তু গলা থেকে শুধু একটা কাঁপা শব্দ বের হয়—
“আমি… দেখেছি তোমায়…”

আয়নাঘর খোলে

(গল্প: আয়নাঘরের শয়তান)

রাহুল মাটিতে পড়ে আছে। গলা থেকে শব্দ বেরোচ্ছে না, শ্বাস আটকে আসছে। আয়নার ভেতর থেকে সেই বিকৃত মুখটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেন সে তার কাজ শেষ করেছে।

কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে—আয়নার এক কোণে একটা চুল ছেঁড়া ছোট্ট লকেট পড়ে থাকতে দেখল রাহুল।
অ্যাঞ্জেলার লকেট।

সে কোনোক্রমে লকেটটা হাতে তুলে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে আয়না আবার কাঁপতে শুরু করে। এবার কাচে আর শুধু প্রতিচ্ছবি নয়—একটা দরজা ফুটে ওঠে! এক গোপন ঘরের চিহ্ন যেন আয়নার ভিতরেই তৈরি হচ্ছে।

রাহুল আয়নার সামনে হাত বাড়াতেই সে টের পেল—কাঁচ নেই! হাতটা ঢুকে গেল আয়নার মধ্যে।

সাহস সঞ্চয় করে সে ভিতরে পা রাখে। তখনই খুলে যায় “আয়নাঘর”।

আয়নাঘরের ভিতর

রাহুল দেখে, সে এখন এক বিশাল ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে—চারপাশে শুধু আয়না, শত শত। প্রতিটা আয়নাতে আটকে আছে আত্মা—কেউ মুছে যাওয়া মুখ, কেউ হাড়ে পরিণত চোখ, কেউ শুধু চিৎকার করছে কিন্তু শব্দ নেই।

ঘরের একদম মাঝে একটা চেয়ার। তাতে বসে আছে—অ্যাঞ্জেলা।

এইবার তাকে মানুষ মনে হয় না। তার শরীরের অর্ধেক ছায়া, অর্ধেক আলো। চোখে শূন্যতা।
সে বলল—
“তুই ভিতরে এসেছিস, মানে তোরও প্রতিচ্ছবি এখানে বন্দী হবে। এখন একটা আত্মা মুক্ত হবে, আর তুই… তার জায়গা নেবি।”

রাহুল চিৎকার করে ওঠে—
“তুই বলেছিলি তোর মুক্তি চাই, এখন আমায় ফাঁসাচ্ছিস শয়তান ?”

অ্যাঞ্জেলা হাসে না, কাঁদেও না। শুধু বলে—
“যে আয়নায় মৃত্যু প্রতিচ্ছবিতে ধরা দেয়, সে আয়না কাউকে বিনা মূল্যে মুক্তি দেয় না।”

ঠিক তখনই রাহুল দেখে আয়নার একদম শেষে, দেয়ালের গায়ে একটা ফাঁকা আয়না।
কোনো মুখ নেই তাতে। শুধু একটা ছায়া ধীরে ধীরে ভরে উঠছে।

সে বুঝে যায়—এই হলো তার প্রতিচ্ছবি।
সে জানে, তাকে কিছু করতে হবে, না হলে সে চিরতরে এই আয়নাঘরে বন্দী হয়ে যাবে।

সে পকেট থেকে বের করে অ্যাঞ্জেলার লকেটটা আছাড় মারে সেই ফাঁকা আয়নায়।
এক ঝলক আলো, একটা বিকট চিৎকার, আর তারপর সবকিছু কেঁপে ওঠে।

রাহুল আবার হুঁশ ফিরে পায় রেভেনকোঠির মূল ঘরে। আয়নাটা এখন কেবল একটুকরো ফাটা কাঁচ।
কোনও মুখ নেই। কেবল আয়নার নিচে পড়ে আছে সেই লকেট।

কিন্তু ক্যামেরা তখনও চলছে। রাহুল নিজের মুখ দেখার জন্য আয়নার ভাঙা টুকরোর দিকে তাকায়…

…আর দেখতে পায়—তার নিজের ছায়া নেই।

মুক্তি, না অভিশাপ?

ঘড়ি তখন রাত ৩টে। রেভেনকোঠির বাতাস ভারী, মৃতপ্রায় নিস্তব্ধতা চারদিকে ছড়িয়ে।

রাহুলের চোখ খুলল। চারপাশ আবার পরিষ্কার।

কিন্তু কিছু একটা ভুল

সব কিছু স্বাভাবিক, আয়নার সামনে সে দাঁড়িয়ে, ক্যামেরা চলছে, আলো জ্বলছে…
কিন্তু সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে না।
তার প্রতিচ্ছবি নেই।

হঠাৎ ক্যামেরা থেকে প্লে-ব্যাক শুরু হয়, যেখানে সে আওয়াজ করছে,

“আমি ফিরে এসেছি… আমি মুক্ত… আমি বেঁচে গেছি…”

কিন্তু সেই কণ্ঠটা রাহুলের নয়।
তা ছিল অ্যাঞ্জেলার কণ্ঠ, তার ঠান্ডা, মৃদু গলা।

রাহুল বুঝতে পারে—সে মুক্ত নয়। অ্যাঞ্জেলা শয়তান এখন তার শরীর নিয়েছে, আর তার আত্মা থেকে গেছে আয়নাঘরে।
সেই ফাঁকা আয়নাটা, যেখানে আগে প্রতিচ্ছবি ছিল না, এখন সেখানে তার মুখ ধরা পড়ছে।

সে আয়নার কাচে হাত রাখে… কিন্তু এবার বাইরে থেকে নয়, ভিতর থেকে

নতুন অভিশাপের জন্ম

ভোরবেলা স্থানীয় গ্রামবাসী দেখতে পায়—রেভেনকোঠির সামনের বারান্দায় এক যুবক বসে আছে, শান্ত মুখে, হাতে একটা ছোট্ট রেকর্ডার আর পুরনো লকেট।
সে পরিচয় দেয় “রাহুল ব্যানার্জি” নামে।

সে বলে:

“রাতটা কেটে গেছে… আমি শুধু একটা প্রতিবেদন নিয়েই ফিরলাম। অভিশাপ বলে কিছু নেই, শুধু ভয় আছে। আমি প্রমাণ নিয়ে ফিরেছি।”

কিন্তু গ্রামের প্রবীণরা জানে, এই ছেলেটি আর আগের রাহুল নয়।
তার চোখে মাঝে মাঝে ধরা পড়ে অতল শূন্যতা, আয়নার মতো নিষ্পলক, অনুভূতিহীন শয়তান চাহনি।

রাত গভীর হলে রাহুল (যার ভিতরে অ্যাঞ্জেলা এখন বাস করছে) তার ঘরের আয়নার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলে ওঠে:

“তোমার জায়গাটা খালি নেই রাহুল, তুমি এখন সেখানে চিরতরে থাকবে… আমি এখন মুক্ত…”

আর আয়নার ভিতর?
একটা মুখ থমকে দাঁড়িয়ে—রক্তাক্ত চোখ, নিঃশব্দ চিৎকার, বন্দী যন্ত্রণা।

 

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *