অপূর্ণ ভালোবাসা

“অপূর্ণ ভালোবাসা

ছোটবেলা থেকেই একে অপরের ছায়াসঙ্গী

আহনা ও আদি—একই পাড়ার দুটি শিশুপ্রাণ, যাদের শৈশব কাটে একে অপরের ছায়ায়। সকাল হলেই দুজনের শুরু হতো একসঙ্গে, স্কুলগাড়ির জানালার পাশে বসা, খেলাধুলার সময় হাত ধরে দৌড়ানো, আর ছোট ছোট বিষয় নিয়ে রাগ-অনুরাগ।

আদি মাঝেমধ্যে স্কুলগাড়িতে আহনার কোলের ওপর বসত, আর সবাই সেটাই স্বাভাবিক ভাবত। আহনার চোখে আদি ছিল সবচেয়ে আপন বন্ধুটি। পাড়ার সবাই জানত এই দুই বন্ধুর গল্প, কিন্তু কেউ ভাবত না—এই বন্ধুত্ব একদিন রূপ নেবে এক অপূর্ণ ভালোবাসায়।

তাদের বন্ধুত্ব ছিল নিঃস্বার্থ, নির্মল—যেন দুইটি হৃদয় জন্ম থেকেই বাঁধা পড়েছিল এক অদৃশ্য বন্ধনে।

সমাজের চোখে ‘বন্ধুত্ব’, পরিবারের চোখে ‘অসম্ভব’

যখন আহনা ও আদি একসাথে বড় হতে থাকে, পাড়া জুড়ে তাদের বন্ধুত্বের কথা ছড়িয়ে পড়ে। সবাই জানত — স্কুলে একসঙ্গে যাওয়া, এক বেঞ্চে বসা, স্কুলের পর খেলতে যাওয়া — যেন একে অপরের ছায়াসঙ্গী।

তবে একসময় সেই বন্ধুত্ব ঘিরেই শুরু হয় কটাক্ষ, গুজব আর সন্দেহ।
পাশের বাড়ির কাকিমারা বলতো — “এই বয়সে ছেলেমেয়ে একসাথে ঘোরা ঠিক না।”
স্কুলের সহপাঠীরাও বলতো — “তোমাদের মাঝে কিছু একটা আছে, না?”

👪 আহনার পরিবার ও আদির পরিবার বিষয়টি লক্ষ্য করলেও, কখনো প্রকাশ্যে কিছু বলেনি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এই সম্পর্কের প্রতি তাদের অনীহা পরিষ্কার ছিল।
একটা সময় পর, পরিবার থেকেই ছাড় দেওয়া হয়নি দুজনকে একসাথে চলার।

আদি বুঝতে পারে — আহনাকে নিয়ে কথা বললে বাড়িতে ঝামেলা হয়।
আহনাও বুঝে যায় — আদির নাম উঠলে মা কেমন মুখ কালো করে ফেলে।

🎭 সমাজের চোখে তারা ছিল ‘বন্ধু’।
কিন্তু পরিবারের চোখে — তাদের সম্পর্ক ছিল ‘অসম্ভব’, ‘অস্বাভাবিক’, এমনকি ‘অগ্রহণযোগ্য’।

সেই থেকে শুরু হয় নিঃশব্দ দূরত্বের পথচলা — যেখানে ভালোবাসা ছিল, অপূর্ণ ভালোবাসা স্বীকৃতি ছিল না।

দূরত্বের শুরু, নিরব অপূর্ণ ভালোবাসার জন্ম

সময় এগিয়ে যায়, বদলে যায় দৃশ্যপট। একসময় একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া আহনা ও আদি, হঠাৎ করেই হয়ে পড়ে দূরের।

সেই দিনগুলো চলে যায়, যখন আদির হাত ধরে আহনা হেসে বলত, “চলো, দৌড়ে স্কুলে যাই!”
এখন আর সেই দৌড় নেই, নেই সেই একসাথে ফেরার মুহূর্ত। আছে কেবল একটা অদৃশ্য দূরত্ব, যা তৈরি হয়েছে সমাজের চোখ রাঙানি আর পরিবারের নিঃশব্দ নিষেধ থেকে।

📚 কলেজে উঠে দুজনই আলাদা হয়ে যায় — আহনা চলে যায় কলকাতায় পড়াশোনার জন্য, আর আদি ও কাজের সূত্রে আসে শহরে, কিন্তু দুজনের পথ আর মেলে না।
আসলে মেলবার মতো পরিবেশ ছিল না, সাহস ছিল না — ছিল কেবল একরাশ না বলা কথা।

📱 আহনার মোবাইল ছিল না তখনও, তাই তার মা’র ফোনেই বন্ধুরা যোগাযোগ করত।
আর সে সুযোগে আদিদেব খবর পেত — “আহনা আজ বেরোবে।”
আর ঠিক তখনই বাইক নিয়ে ছুটে যেত সে, শুধু একবার দেখতে পারবে বলে!

আহনা জানত — আদি আশেপাশে ঘোরে, চুপিচুপি তাকিয়ে দেখে।
ওরও ইচ্ছে করত কথা বলার, কিন্তু কিছু একটা বাঁধা ছিল — সমাজের, পরিবারের, কিংবা নিজের ভিতরের দ্বিধার।

এইভাবেই একদিকে তৈরি হয় নিরব ভালোবাসা, আর অন্যদিকে গেঁথে যেতে থাকে অদৃশ্য দূরত্বের দেয়াল

এক পলক দেখার আনন্দ, আরেক হৃদয়ের ধুকপুকানি

আদি-র দিনগুলো যেন একটি মাত্র অপেক্ষায় কাটত — আহনাকে এক পলক দেখার অপেক্ষা।
সে জানত, আহনার বাড়ির পাশের রাস্তাটি দিয়ে গেলে হয়তো দেখা মিলবে।

বাইকে করে আস্তে আস্তে সেই রাস্তায় যেত আদি, মনে মনে ভাবত —
“আজ হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে ও… আজ হয়তো চোখাচোখি হবে…”

আর যদি কখনো সত্যিই দেখা পেয়ে যেত?
তাহলেই তার হৃদয়ে নেমে আসত উৎসবের রঙ, চোখে ভেসে উঠত এক অপূর্ণ ভালোবাসা কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসার রূপ।
সেদিন বাইকের গতি হঠাৎ দ্বিগুণ হয়ে যেত, ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠত এক চুপিচুপি হাসি —
আর চোখের ভিতর লুকিয়ে থাকত হাজারো না বলা কথা।

অপূর্ণ ভালোবাসার প্রতীক

🌧️ আহনা জানালার পাশে বসে থাকত, বাইরে তাকিয়ে থাকত — আর বুঝে যেত, বাইক চলার শব্দটা কার।
ওর মনটাও ধুকধুক করত — কিন্তু মুখে কিছু বলত না।

তাদের মাঝে কোনো কথা হতো না, কিন্তু দুজনেই অনুভব করত একে অপরের উপস্থিতি।
এ এক গভীর, নিরব, মধুর ব্যথা —
যেখানে একপলক দেখা মানেই হৃদয়ের এক অনন্ত ধ্বনি।

সময়ের পালাবদল, কিন্তু হৃদয়ের অনুভব ঠিক একই

সময় কখনো কারও জন্য থেমে থাকে না।
আহনা আর আদি—আজ আর সেই স্কুল পড়ুয়া কিশোর-কিশোরী নয়।
তারা এখন বড় হয়েছে, জীবন তাদের নিয়ে গেছে আলাদা পথে।

📚 আহনা এখন কলকাতার এক নামকরা কলেজে পড়াশোনা করে, নিজের স্বপ্ন নিয়ে ব্যস্ত।
🧑‍💼 আদি ও এখন কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে — একই শহরে থেকেও যেন তারা আলাদা গ্রহের বাসিন্দা।

তবে, সময় যতই পাল্টাক, তাদের হৃদয়ের অনুভব ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে
আদি আজও জানে — আহনার জন্মদিন, ওর প্রিয় রঙ, ওর পড়ার সাবজেক্ট…
আহনা আজও জানে — আদি কোন রুটে বাইক চালায়, কোন বন্ধুর সঙ্গে এখনো যোগাযোগ রাখে।

তারা দুজনেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একে অপরকে খুঁজে দেখে, কখনো লাইক দেয় না, কমেন্ট করে না —
তবুও প্রতিদিন প্রোফাইল ঘেঁটে দেখে কেউ কেমন আছে।

এই একরকমের নীরব অপূর্ণ ভালোবাসা — যা কোনো শব্দ চায় না, শুধু অনুভবে বেঁচে থাকে।

আজও আদির মনে হয় —
“জানি কিছুই হবে না, তবুও যদি আরেকবার দেখা হতো… যদি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে পারতাম — আমি এখনো ভালোবাসি…”

আহনার মনেও একটাই প্রশ্ন —
“এত বছর কেটে গেল, তবুও কেন আদি চোখে চোখ রাখলে বুক কাঁপে?”

অতৃপ্ত ভালোবাসার চিঠি – (আদি-র কলমে)

প্রিয় আহনা,

জানি এই চিঠি তোমার হাতে পৌঁছাবে না। হয়তো তুমি কখনো পড়বে না, হয়তো পড়লেও বুঝবে না—আমার প্রতিটি শব্দে কতটা চাপা কষ্ট লুকিয়ে আছে।

তবুও লিখছি। কারণ আর পারছি না চুপ থাকতে।

আমরা একসঙ্গে বড় হয়েছি, সেই ছোট্ট হাত ধরাধরি থেকে শুরু করে স্কুলের বেঞ্চ ভাগ করে নেওয়া—সব কিছু আজও মনে আছে।
জানো, সেইসব দিনগুলোই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় ছিল।

বুঝেছিলাম অনেক আগেই, তুমি আমার জন্য ‘বন্ধু’র থেকেও অনেক বেশি কিছু।
কিন্তু সমাজ, পরিবার, পরিস্থিতি—সবকিছুই যেন আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

আমি চেয়েছিলাম তোমাকে শুধু একবার বলতে—
“তুমি ছাড়া আমি কিছুই না।”
কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি।

তোমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মুখটা আজও চোখে ভাসে।
বাইক চালাতে চালাতে তোমার একটা চোখের চাহনি পেলে আমি দিনটা বাঁচিয়ে ফেলতাম।
জানি, তুমি বুঝতে। কিন্তু তোমার মতো আমিও চুপ করে থাকতাম।

আজ এত বছর পরও, আমি কোনো সম্পর্ক গড়তে পারিনি।
কারণ, আমি তো তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসিনি।

যদি কোনোদিন আমাদের দেখা হয়, আমি শুধু একটা কথা বলব—
“তুমি এসেছিস এই পৃথিবীতে শুধুই আমার জন্য।”

ভালো থেকো আহনা।
তোমাকে হারানোর ব্যথা আমি বহন করব, তোমাকে ভালোবাসার সৌভাগ্য হয়তো কারও হবে না।

তোমার,
আদি

chatgpt image aug 6, 2025, 08 44 16 pm

অপূর্ণ ভালোবাসার শেষ কি অপূর্ণই থেকে যায়?

ভালোবাসা—এমন একটি অনুভূতি যা সবসময় সমাপ্তি খোঁজে না।
কখনো সেটা শুধুই একপাক্ষিক, কখনো মুখে বলা হয় না, আর কখনো সমাজ-পরিবার-সময়—সবকিছু মিলে তাকে অপূর্ণ রেখেই বিদায় দেয়।

আহনা ও আদিদেবের গল্পও ঠিক তেমনই।
তারা একে অপরকে ভালোবাসত, হৃদয়ের গভীর থেকে।
কিন্তু তারা তা কখনো বলেনি, প্রকাশ করেনি, কিংবা একে অপরকে জোর করেও ধরে রাখেনি।

তাদের মাঝে ছিল হাজারো না বলা কথা, হাজারো চাওয়া-পাওয়া, স্মৃতির ভারে নুয়ে থাকা চোখের পলক।
তবুও তারা একে অপরের প্রিয় রয়ে গেছে — নীরব অপূর্ণ ভালোবাসার প্রতীক হয়ে।

🎭 পৃথিবীতে এমন অনেক ভালোবাসা আছে যা শুরু হয়, কিন্তু শেষ হয় না।
তাদের শেষ হয় — না বলা কষ্টে, চোখের জল ভেজা রাতে, কিংবা কোনো এক জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুখের দিকে চেয়ে।

প্রিয় পাঠক,
আপনি যে সময় নিয়ে এই গল্পটি পড়লেন, সেটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
” অপূর্ণ ভালোবাসার গল্প” কেবল একটি কল্পনার সৃষ্টি নয়, এটি সেই সব না বলা অনুভবের প্রতিচ্ছবি, যা বহু হৃদয়ে চাপা পড়ে থাকে।

আমরা জানি, ভালোবাসা সব সময় গল্পের মতো সুন্দর হয় না।
তবুও সেই অপূর্ণতা, সেই নীরব ভালোবাসা—এটাই আমাদের জীবনের গভীরতম অধ্যায় হয়ে থাকে।

গল্পকথা-এ আমরা চেষ্টা করি এমন গল্প বলার, যা আপনাকে স্পর্শ করে, আপনাকে ভাবায়, কখনো হয়তো আপনাকে আপনার নিজের জীবনের গল্পের সঙ্গে মিল খুঁজে পেতে সাহায্য করে।

আপনার মতামত, অনুভূতি ও পরামর্শ আমাদের কাছে অমূল্য।
আপনি চাইলে কমেন্টে জানাতে পারেন—এই গল্পটি আপনাকে কতটা ছুঁয়ে গেল।
অথবা লিখে ফেলুন আপনার নিজের অপূর্ণ ভালোবাসার গল্প, যেটি হয়তো কোনো দিন কেউ শোনেনি।

ধন্যবাদ,
– গল্পকথা পরিবার

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *