অন্ধকার বনভূমির আহ্বান
রহস্যময় বন
সন্ধ্যা নামলেই গ্রামের মানুষ দাওয়ায় আলো জ্বালিয়ে বসে থাকে। দূর থেকে ভেসে আসে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, হাওয়ার সঙ্গে গাছের পাতার সোঁ সোঁ শব্দ। কিন্তু গ্রামের ঠিক উত্তরে যে ঘন অরণ্য, সেখানে নামলেই হাওয়া থমকে যায়, চারদিক যেন হঠাৎ নিস্তব্ধ।
লোকজন বলে, ওই বনভূমি নাকি “জীবন্ত”—ওই বনের গাছেরা নিশ্বাস নেয়, মাটির নীচে কবর দেওয়া মৃতদেহেরা রাত হলে নড়ে ওঠে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো রাত বারোটার বাঁশি বাজা।
কেউ জানে না বাঁশি বাজায় কে। শুধু শোনা যায়—কখনো কাছে, কখনো দূরে, কখনো মাথার ঠিক পেছনে।
যে-ই সেই সুরের টানে বনের ভেতরে গিয়েছে, তাকে আর কখনো জীবিত দেখা যায়নি।
এক বৃদ্ধ বলেছিল,
“ওই বাঁশির আওয়াজ আসলে ডাক। বন ডাকে… আত্মারা ডাকে। কেউ যদি শোনার সাহস করে, তার শরীর ফেরে… কিন্তু প্রাণ ফেরে না।”
গ্রামের লোকেরা এত ভয়ে থাকে যে রাত নামলেই কুকুর-বেড়াল পর্যন্ত বনের ধার ঘেঁষে যায় না।
কিন্তু ওই রাতেই, একদল কৌতূহলী তরুণী আর তরুণ, সাহস দেখিয়ে বনভূমির ভেতরে ঢোকার সিদ্ধান্ত নিল।
চাঁদের আলো ম্লান, কুয়াশা ধীরে ধীরে নামছে। তাদের হাতে টর্চ, চোখে জেদ, মনে কৌতূহল।
যখন প্রথম পদক্ষেপ পড়ল অন্ধকার বনের ভিতরে—চারপাশের সব শব্দ হঠাৎ থেমে গেল। যেন বনটা নিশ্বাস আটকে অপেক্ষা করছে।
হঠাৎ টর্চের আলো নিভে গেল একসাথে।
অন্ধকার ঘন হয়ে এল।
এরপর… শোনা গেল সেই বাঁশির সুর।
ধীরে ধীরে, গভীর বেদনার মতো—
সেই সুরে রক্ত হিম হয়ে যায়, হৃদস্পন্দন যেন বুকে থেমে আসে।
চারজনই ভয়ে একে অপরকে জড়িয়ে দাঁড়াল।
কিন্তু সুর থামল না… বরং মনে হলো, ঠিক তাদের কানের পাশে কেউ বাজাচ্ছে—
তবুও চারপাশে অন্ধকার ছাড়া কিছুই নেই।
হঠাৎ পেছন থেকে ফিসফিস আওয়াজ ভেসে এল—
“ফিরে যা… না হলে… তুইও আমাদের মতো হারিয়ে যাবি…”
তারা পিছন ফিরল—কেউ নেই।
শুধু ভেজা মাটির গন্ধ, আর গাছের গোড়ায় কাদামাটিতে হঠাৎই দেখা গেল রক্তমাখা হাতের ছাপ।
বনের আহ্বান শুরু হয়ে গেছে…
অভিযানের সূচনা
চারজন—অভিজিৎ, রূপা, অনিকেত আর মীরা।
গ্রামের সবাই তাদের বারণ করেছিল, কিন্তু কৌতূহলের নেশায় তারা থামেনি।
টর্চ নেভে-জ্বলে, বাঁশির সুর থেমে থেমে গাছে গাছে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে শুকনো পাতা চাপা পড়ে খসখস শব্দ উঠছে, অথচ আশ্চর্যজনকভাবে বনভূমির পাখি-পোকা একটাও শব্দ করছে না। যেন পুরো বনটা মরে গেছে।
মীরা ফিসফিস করে বলল—
“আমরা কি সত্যিই এগোবো? মনে হচ্ছে কেউ আমাদের দেখছে…”
রূপা কাঁপা গলায় উত্তর দিল—
“এখন তো পেছনে ফেরার উপায় নেই। বাঁশি বাজছে… আমি শপথ করে বলছি, এই সুরে একটা অদ্ভুত টান আছে।”
হঠাৎ, অনিকেতের চোখে পড়ল সামনে মাটিতে একটা ভাঙা কাঠের মুখোশ।
মুখোশটা অদ্ভুত—লাল রঙে মাখামাখি, চোখের গর্তগুলো শূন্য, কিন্তু তাকিয়ে থাকলেই মনে হয় কেউ তাকিয়ে আছে।
সে ঝুঁকে তুলতে যাবে, অভিজিৎ ঝাঁপিয়ে হাত সরিয়ে দিল।
“পাগল নাকি? এসব জিনিস স্পর্শ করিস না। দেখছিস না, রক্তে ভিজে আছে?”
মুখোশটা হঠাৎ কেঁপে উঠল।
তাদের সামনে কেউ নেই, তবুও সেটা ধীরে ধীরে মাটির ভেতরে ঢুকে গেল।
চারজন নিঃশব্দে জমে দাঁড়িয়ে রইল।
এরপর আবার বাঁশি বাজল। এবার কাছে… অনেক কাছে।
বাঁশির সুরের সঙ্গে যেন একটা মেয়েলি কণ্ঠের কান্না মিশে আছে।
আওয়াজটা গাছের ভেতর থেকে আসছে বলে মনে হলো।
মীরা কাঁপতে কাঁপতে বলল—
“এটা মানুষ নয়… এটা বন ডেকে নিচ্ছে আমাদের।”
হঠাৎ চারপাশের গাছগুলো একসাথে দুলে উঠল, অথচ বাতাসের হালকা ছোঁয়াও নেই।
কেউ যেন অদৃশ্য হাত দিয়ে তাদের ধাক্কা দিচ্ছে।
টর্চ আবার নিভে গেল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চারজন শুধু শুনতে পেল—
চারদিক থেকে ভেসে আসছে শত শত ফিসফিস কণ্ঠস্বর, যেন মৃতরা একই সঙ্গে কথা বলছে—
“এসো… এসো… তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি…”
অভিজিৎ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল—
“কে আছিস? সামনে আস!”
ঠিক সেই মুহূর্তে তার কাঁধে ঠান্ডা বরফের মতো এক হাত চাপা পড়ল।
সবাই টর্চ জ্বালাতেই দেখল—অভিজিতের কাঁধে রাখা হাতটা পচা, রক্তমাখা, কাটা হাতের মতো!
আর মাথাহীন একটা দেহ গাছের আড়াল থেকে এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে…
অদ্ভুত লক্ষণ
মাথাহীন দেহটা ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসছে।
গাছের ফাঁক দিয়ে তার গলায় শুকনো রক্ত জমাট বেঁধে আছে, হাত দুটো নড়ছে না, যেন অদৃশ্য শক্তি দিয়ে টেনে আনা হচ্ছে।
মীরা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। অভিজিৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখল—তার কাঁধে রাখা পচা হাতটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।
কিন্তু মাটিতে ভিজে ভিজে রক্তের দাগ ছড়িয়ে আছে।
ওরা একসাথে দৌড়ে গেল আরও গভীর দিকে।
দৌড়াতে দৌড়াতে বুঝল, তাদের চারপাশে একটা অদ্ভুত খেলা হচ্ছে—যেদিকেই যাচ্ছে, পথ যেন বারবার একই জায়গায় ফিরিয়ে আনছে।
রূপা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—
“এটা অসম্ভব… আমরা তো দক্ষিণ দিকেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু এই গাছটা আমি আগেও দেখেছি।”
গাছের গুঁড়িতে অদ্ভুত কিছু খোদাই করা—ত্রিকোণ চিহ্ন, তার ভেতরে লাল কালিতে আঁকা চোখ।
চোখটা যেন জীবন্ত… তাদের নড়াচড়া অনুসরণ করছে।
অনিকেত গায়ে কাঁটা দিয়ে বলল—
“এটা তান্ত্রিক চিহ্ন… কালো যজ্ঞের চিহ্ন।”
ঠিক তখনই মাটির নীচ থেকে শব্দ হলো—
মনে হলো কেউ গর্ত খুঁড়ছে ভেতরে, আর ভাঙা নখ দিয়ে মাটি আঁচড়াচ্ছে।
একসময় নরম মাটি ফেটে গেল, আর সেখান থেকে বেরিয়ে এলো শুকনো হাতের হাড়।
হাড়গুলো নড়ছে, যেন ওদের দিকে হামাগুড়ি দিচ্ছে।
হঠাৎ কম্পাস বের করল অভিজিৎ—
কিন্তু সূচকটা পাগলের মতো ঘুরছে, উত্তর-দক্ষিণ কিছুই বুঝতে পারছে না।
আর টর্চের আলো যেদিকে ফেলা হচ্ছে, সেদিকেই এক মুহূর্তের জন্য দেখা যাচ্ছে মুখবিহীন ছায়া দাঁড়িয়ে আছে।
মীরা কান্নাজড়ানো গলায় বলল—
“আমরা বোধহয় আর ফিরতে পারব না… এই বন আমাদের আটকে ফেলেছে।”
তার কথা শেষ হতেই বাঁশির সুর আবার বেজে উঠল।
এবার এত কাছে যে মনে হলো, বাঁশি বাজছে ওদের ঠিক কানের ভেতরে।
সুরের সঙ্গে মিশে গেল এক অদ্ভুত হাসি—খিকখিক, ভেজা গলায়, যেন গলা কাটা কারও হাহাকার।
চারজন স্তব্ধ হয়ে গেল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে, রূপা হঠাৎ আঁতকে উঠে চিৎকার করল—
“কে… কে আমার নাম ধরে ডাকছে?”
অভিজিৎ, অনিকেত, মীরা অবাক হয়ে তাকাল—
কেউ তো কিছু শোনেনি।
রূপার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
সে কেঁপে কেঁপে বলল—
“একটা কণ্ঠ আমার কানে ফিসফিস করে বলল… ‘রূপা, তুই একা হয়ে যাচ্ছিস… তোর বন্ধুদের আমরা নিয়ে নেব… তারপর তুই আমাদের সঙ্গী হবি।’”
চারপাশে আবার হঠাৎ নীরবতা নেমে এলো।
শুধু গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে যেন অদৃশ্য কারও লাল চোখ জ্বলজ্বল করছে।
অতীতের অভিশাপ
চারজন অস্থির পায়ে এগোতে লাগল বনের গভীরে।
চারপাশে কুয়াশা ঘনীভূত হচ্ছে, টর্চের আলোও যেন ভেদ করতে পারছে না।
হঠাৎ সামনে দেখা গেল একটা জীর্ণ কুঁড়েঘর—চারদিকে শুকনো লতা-পাতায় মোড়া, যেন বহু বছর ধরে কেউ ঢোকেনি।
অভিজিৎ সাবধানে দরজা ঠেলতেই সেটি কর্কশ শব্দ করে খুলে গেল।
ভেতরে গা-শিউরে ওঠার মতো দৃশ্য—
কালো দেওয়ালে অদ্ভুত প্রতীক আঁকা, মাটির উপর শুকনো হাড়ের স্তূপ, আর মাঝখানে পোড়া যজ্ঞকুণ্ড।
যজ্ঞকুণ্ডের ছাইয়ের ভেতর এখনও যেন ধোঁয়া উড়ছে… অথচ এই কুঁড়েঘর বহু শতাব্দী ধরে পরিত্যক্ত।
অনিকেত কাঁপা গলায় বলল—
“এটা… এটাই সেই তান্ত্রিকের আস্তানা।”
ঠিক তখন মাটির কোণে পুরোনো একটা চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরি পড়ে থাকতে দেখা গেল।
অভিজিৎ কাঁপতে কাঁপতে সেটা তুলল।
পাতাগুলো জীর্ণ, কিন্তু কালি এখনও লালচে দাগে ভরা।
প্রথম পাতায় লেখা—
“আজ সপ্তম রাত। যজ্ঞ অসম্পূর্ণ।
অর্ধেক আত্মা আমি বেঁধেছি, অর্ধেক পালিয়ে গেছে।
যতদিন না তাদের ফিরিয়ে আনি, বন আমাকে রক্ত চাইবে।”
পড়তে পড়তে তাদের মুখ শুকিয়ে গেল।
ডায়েরিতে আরও লেখা ছিল—
“মানুষ বাঁশির সুরে টান খেয়ে আসে।
তাদের আত্মা বনভূমি গিলে খায়।
আমি ব্যর্থ হয়েছি শেষ যজ্ঞে… কিন্তু বন আমার সঙ্গী।
এবার বন নিজেই শিকার ডাকবে।”
হঠাৎ রূপার চোখ ডায়েরির শেষ পাতায় আটকে গেল।
সেখানে অদ্ভুত আঁকিবুকি—একটা বৃত্তের ভেতরে চারটা মানুষের ছবি আঁকা।
ছবির পাশে লেখা—
“চতুর্থ প্রজন্মে চারজন আসবে।
তাদের রক্তে যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে।”
চারজন নিঃশ্বাস বন্ধ করে একে অপরের দিকে তাকাল।
তাদের বুকের ভেতর কাঁপুনি ছড়িয়ে গেল।
অভিজিৎ ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল—
“মানে… আমরা-ই সেই চারজন?”
কুঁড়েঘরের দেওয়ালে হঠাৎ আঁকা প্রতীকগুলো রক্তের মতো ভিজে উঠল।
এক মুহূর্তে সব মোমবাতি নিজে থেকেই জ্বলে উঠল।
আর যজ্ঞকুণ্ড থেকে উঠল এক ভয়াবহ কালো ছায়া, যার চোখ আগুনের মতো জ্বলছে।
ছায়াটা ফিসফিস করে বলল—
“তোমরা এসেছ… অবশেষে আমার যজ্ঞ পূর্ণ হবে…”
চারপাশে বাঁশির সুর গর্জে উঠল, যেন হাজার মৃত আত্মা একসাথে শোকগীতি বাজাচ্ছে।
বিভীষিকাময় রাত
কালো ছায়াটা যজ্ঞকুণ্ড থেকে ধোঁয়ার মতো বেরিয়ে এসে চারজনকে ঘিরে ফেলল।
চারদিকে বাতাস হিমশীতল হয়ে গেল, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
বাঁশির সুর এবার রক্ত জমে যাওয়ার মতো কর্কশ, তার সঙ্গে মিলল অসংখ্য আত্মার কান্না আর হাসি।
হঠাৎ মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে এল একের পর এক কঙ্কাল।
তাদের ফাঁপা চোখের গর্ত থেকে সবুজ আগুন জ্বলছিল, আর দাঁত খিড়মিড় শব্দে কাঁপছিল।
রূপা চিৎকার করে উঠল—
“আমাদের পালাতে হবে!”
কিন্তু পেছনের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।
দরজা নেই, শুধু দেওয়াল—যেন কখনো কোনো দরজাই ছিল না।
হঠাৎ কঙ্কালের ভিড় থেকে একটি হাত ঝাঁপিয়ে পড়ে মীরার পায়ের গোড়ালি আঁকড়ে ধরল।
সে মাটিতে পড়ে গেল, তার মুখ থেকে ভয়ঙ্কর চিৎকার বেরিয়ে এলো।
অভিজিৎ আর অনিকেত টানতে লাগল তাকে বাঁচানোর জন্য, কিন্তু অদ্ভুত শক্তি তাকে টেনে নিচ্ছিল কুঁড়েঘরের মেঝের ভেতরে।
মীরা কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করল—
“বাঁচাও… ওরা আমাকে টেনে নিচ্ছে…! না-আ-আ!”
এক মুহূর্তেই তার শরীর মাটির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।
শুধু রক্তে ভিজে থাকা নখের আঁচড় রয়ে গেল মেঝেতে।
বাকি তিনজন স্তব্ধ হয়ে গেল।
রূপা hysterically কাঁদতে লাগল, অনিকেত প্রার্থনা জপতে লাগল, আর অভিজিৎ দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়াল।
ঠিক তখন আবার বাঁশির সুর থেমে গেল।
চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
নিস্তব্ধতার ভেতর এক নারীকণ্ঠ ফিসফিস করে উঠল—
“একজন গেল… বাকি তিনজন বাকি…”
টর্চ আবার জ্বলে উঠল, আর আলো পড়তেই দেখা গেল—কুঁড়েঘরের দেওয়ালে চারজনের ছায়া ঝুলছে।
কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার হলো—মীরার ছায়া এখনও আছে।
যেন সে এখানেই আটকে গেছে, ছায়া হয়ে বন্দি।
অনিকেত আতঙ্কে দরজা খুঁজতে খুঁজতে হোঁচট খেয়ে পড়ল।
পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখে পড়ল—মেঝেতে একটা রক্তমাখা আয়না রাখা।
সে যখন নিজের মুখ দেখতে গেল, চিৎকার করে পিছিয়ে এল।
কারণ আয়নায় তার মুখ নেই—
বরং দেখা যাচ্ছে একটা পচা মুখ, ফাঁকা চোখের গর্ত আর কেটে যাওয়া ঠোঁট, যা তাকে কর্কশ গলায় হাসছে।
রূপা আর অভিজিৎ তাকে টেনে তুলল।
কিন্তু আয়নার ভেতরের সেই বিকৃত মুখ হঠাৎ ফিসফিস করে বলল—
“অনিকেত… এবার তোর পালা।”
কুঁড়েঘরের ভেতর হঠাৎ সব দিক থেকে হাত বেরিয়ে এলো—হাড়ের, পচা মাংসের, কালো ধোঁয়ার।
অভিশপ্ত আত্মারা তাদের ঘিরে ফেলল।
বাঁশির সুর আবার বাজল, এবার এত তীক্ষ্ণ যে মনে হচ্ছিল কানে রক্ত বেরিয়ে আসবে।
অভিজিৎ চিৎকার করে উঠল—
“দৌড়াও! যেভাবেই হোক বেরোতে হবে, নাহলে সকলে শেষ!”
আহ্বানের রহস্য
অভিজিৎ, রূপা আর অনিকেত প্রাণপণে দৌড়ে বেরিয়ে এলো কুঁড়েঘর থেকে।
কিন্তু বাইরে বেরিয়েও তারা যেন মুক্ত নয়—
চারপাশে একই রকম গাছ, একই রকম কুয়াশা, আর সেই বাঁশির অভিশপ্ত সুর।
রূপা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—
“আমরা বোধহয় ঘুরে ফিরে একই জায়গায় আটকে যাচ্ছি…”
অভিজিৎ দাঁত চেপে বলল—
“না, আমাদের থামতে হবে না। এই বন যাদু দিয়ে আমাদের ফাঁদে ফেলছে।”
ঠিক তখনই অনিকেতের পা কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেল।
সে পড়ে গিয়ে দেখল, মাটিতে একটা অদ্ভুত পাথরের ফলক।
ফলকের গায়ে খোদাই করা অজানা ভাষার শব্দ, আর পাশে একটা শুকনো খুলি।
খুলিটার কপালে রক্তে লেখা—
“আহ্বান পূর্ণ হলে বন মুক্তি পাবে।”
অনিকেত ডায়েরির কথা মনে করল।
তান্ত্রিক লিখেছিল যজ্ঞ অসম্পূর্ণ।
মানে বন এখনও আত্মা চাইছে, আর তারা—তাদের চারজন—হচ্ছে সেই যজ্ঞের চাবিকাঠি।
হঠাৎ রূপার কানে আবার সেই ফিসফিস—
“তুইই শেষ চাবি… তোর রক্তেই দরজা খুলবে।”
রূপা কান চেপে চিৎকার করতে লাগল, কিন্তু আওয়াজটা আরও তীব্র হলো।
হঠাৎ তার শরীর কাঁপতে শুরু করল, চোখ উলটে গেল, আর মুখ দিয়ে বেরোল ভিন্ন স্বর—
“আমি ফিরব… শত বছর পর…
আমার যজ্ঞ এবার সম্পূর্ণ হবে।
তোমরা এসেছ, আমার আহ্বান শুনে এসেছ।
এবার কেউ ফিরবে না।”
অভিজিৎ আর অনিকেত ভয়ে পেছিয়ে গেল।
তাদের চোখের সামনে রূপার শরীর কেঁপে উঠতে উঠতে ধীরে ধীরে রক্তে ভিজে যেতে লাগল, অথচ কোনো ক্ষত নেই।
তার পিঠে হঠাৎ দগদগে অক্ষরে ফুটে উঠল তান্ত্রিক প্রতীক।
অভিজিৎ চিৎকার করল—
“না! এটা রূপা নয়… ওর শরীরে তান্ত্রিক ঢুকে গেছে!”
তখন বনভূমির ভেতর থেকে হাহাকার ভেসে এলো।
মাটির নীচ থেকে একসাথে শত শত হাত বেরিয়ে আসল—কোনোটা হাড়ের, কোনোটা পচা মাংসের।
তাদের হাত গিয়ে আঁকড়ে ধরল রূপার শরীর, আর টেনে নিয়ে গেল যজ্ঞকুণ্ডের দিকে।
বাঁশির সুর এবার বদলে গেল—
এটা আর টান নয়, এটা বলি দেওয়ার সুর।
অনিকেত ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে অভিজিতের হাত ধরল।
“আমরা শেষ… ওরা আমাদের নিয়েই যজ্ঞ পূর্ণ করবে…”
অভিজিৎ দাঁত চেপে বলল—
“না! কোনোভাবে এই অভিশাপ ভাঙতে হবে… নাহলে সবাই মরব।”
তখনই হাওয়ার ঝাপটায় ডায়েরির ছেঁড়া একটা পাতা তাদের পায়ের সামনে এসে পড়ল।
সেখানে লেখা—
“যজ্ঞ থামাতে চাইলে আগুনের বৃত্ত ভাঙতে হবে।
কিন্তু সতর্ক হও… যে ভাঙবে, সে আর বাঁচবে না।”
অভিজিৎ পাতাটা হাতে তুলে নিল।
তার চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা জ্বলে উঠল।
মৃত্যুর দরজা
ডায়েরির পাতার লেখা হাতে আঁকড়ে ধরে অভিজিৎ দাঁড়িয়ে রইল।
তার সামনে রূপার শরীর ধীরে ধীরে যজ্ঞকুণ্ডের আগুনে ভেসে উঠছে, চোখদুটো লাল হয়ে গেছে, মুখ থেকে বেরোচ্ছে তান্ত্রিকের কর্কশ হাসি।
অনিকেত চিৎকার করে বলল—
“তুই কিছু করলে তুই মরবি! আমরা কেউ ফিরব না!”
অভিজিৎ গর্জে উঠল—
“কেউ না কেউ মরবই… অন্তত শেষজনকে বাঁচাতে হবে!”
সে ডায়েরির পাতাটা যজ্ঞকুণ্ডে ছুঁড়ে দিল।
আগুন হঠাৎ আকাশ ছুঁয়ে উঠল, আর চারপাশে আত্মাদের চিৎকার প্রতিধ্বনিত হলো।

কালো ছায়া গর্জে উঠল—
“না-আ-আ! শত বছর পর আমার যজ্ঞ পূর্ণ হবার ছিল… তোমরা সাহস করলে এটা ভাঙার?”
অভিজিৎ যজ্ঞকুণ্ডের ভেতরে ঝাঁপ দিল।
তার শরীর মুহূর্তে আগুনে পুড়ে যেতে লাগল, কিন্তু শেষ শক্তি দিয়ে সে রক্তে ভেজা মাটিতে আঁকা প্রতীক ভেঙে দিল।
মুহূর্তেই বন কেঁপে উঠল।
সব কঙ্কাল, সব ছায়া, সব আত্মা একসাথে হাহাকার করতে করতে ভস্ম হয়ে গেল।
রূপার শরীর হঠাৎ কুঁদে উঠল, তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল—চোখে আর তান্ত্রিকের ছাপ নেই, কিন্তু নিস্তেজ, অচেতন।
বাঁশির সুর থেমে গেল।
চারপাশে গভীর নীরবতা।
অনিকেত হাঁপাতে হাঁপাতে রূপাকে টেনে ধরল।
কিন্তু যজ্ঞকুণ্ডে তাকাতেই সে জমে গেল—
অভিজিৎ নেই, শুধু ছাই আর আগুনের ভেতর ভাসমান এক টুকরো ছায়া… যেন সে বনভূমির ভেতরেই বন্দি হয়ে গেল।
হঠাৎ বাতাসে কানে এলো অভিজিতের ফিসফিস—
“আমি গেছি… কিন্তু তোমরা এখনই বেরিয়ে যাও… এই বন আবার ডাকবে…”
অনিকেত আর রূপা কাঁপতে কাঁপতে বনের বাইরে দৌড়ে এল।
প্রথমবারের মতো তাদের সামনে ভোরের আলো ফুটল।
মনে হলো তারা মুক্ত।
কিন্তু…
পেছনে তাকাতেই অনিকেতের বুক শুকিয়ে গেল।
দূরে অন্ধকার বনভূমির গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে নিস্তব্ধ,
আর কুয়াশার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে ভেসে এলো সেই বাঁশির সুর…
একেবারে আগের মতো—
শীতল, অদ্ভুত, আর ভয়ঙ্কর টানভরা।